বাংলা কাব্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান
বাংলা মহাকাব্যের ধারায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থান নির্ণয় করো।
⇒ 'বৃত্রসংহার' কাব্যের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মধুসূদনের উত্তরসূরী রূপে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মূলত মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশের পর তার মহাকাব্য রচনার প্রতিভায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হেমচন্দ্র মহাকবি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাংলা কাব্য জগতে অবতীর্ণ হন। বাংলা কাব্য জগতে রঙ্গলাল-মধুসূদন-হেমচন্দ্রের আবির্ভাব প্রায় একই সময় হলেও এদের প্রতিভা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। রঙ্গলাল বাংলা কাব্যে স্বদেশ চেতনাকে আনয়ন করেছিলেন, মধুসূদন বাংলা কাব্যকে আধুনিকতার ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিয়েছিলেন, আর হেমচন্দ্র বাংলা কাব্যে হিন্দু সংস্কৃতির ভাব তথা জাতীয়তার বিকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
মধুসূদন বাংলা কাব্যের যে ক্লাসিক মহিমা গড়ে তুলেছিলেন তাকে অনুসরন করা বা তার উত্তরাধীকার বহন করার মতো প্রতিভা হেমচন্দ্র বা নবীনচন্দ্র কারোরই ছিল না। তবুও মধুসূদনের পর হেমচন্দ্রই সর্বাধিক শিক্ষিত মহৎ কবি। তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট কবি। মধুসূদনকে গুরুপদে বহন করে মহাকাব্য রচনায় তিনি অগ্রসর হন। মধুসূদনের মতো প্রতিভা তার ছিল না, তবু একথা বলাই যায় মধুসূদনের পর বাংলা মহাকাব্য রচনার গৌরব যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তিনি হেমচন্দ্র বন্দ্যেপাধ্যায়। অবশ্য শুধু মহাকাব্য নয়, নানা ধরনের কাব্য, লিরিক কবিতা, রঙ্গব্যঙ্গের কবিতা, নাটকের অনুবাদ, কবিতার অনুবাদ প্রভৃতির দ্বারা হেমচন্দ্র বাংলা কাব্য সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হলো- 'বৃত্রসংহার', 'বীরবাহু কাব্য', 'ছায়াময়ী', 'নলিনীবসন্ত', 'আশাকানন', 'কবিতাবলী', 'চিত্তবিকাশ', 'দশমহাবিদ্যা' 'নাকে খৎ' ইত্যাদি। তবে এই সব রচনায় তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় না। মহাকাব্যের পরিকল্পনা নিয়ে রচিত 'বৃত্রসংহার'- ই হেমচন্দ্রের খ্যাতির প্রধান কারণ।
বৃত্রসংহার কাব্যের পটভূমি যেমন বিরাট বিষয়, তেমনি বিরাট আদর্শে পরিকল্পিত। কবি পৌরানিক সাহিত্য থেকে দেবগন কর্তৃক বৃত্রসংহারের কাহিনিকেই মহাকাব্যে গ্রহণ করেছেন । বৃত্রাসুর দৈববলে বলীয়ান হয়ে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলে, দেবতারা শিবের কাছে যান। শিবের পরামর্শে দধীচি মুনির অস্থি নির্মিত বজ্রে ইন্দ্র বৃত্রকে সংহার করেন। পুরাণের কাহিনি অনুসরণ করলেও কবি কোথাও কোথাও নতুন বিষয়ের সংযোগ ঘটিয়েছেন। কাহিনির দৈর্ঘ্য ও বিশালতা মহাকাব্যের সম্পূর্ণ উপযুক্ত হয়েছে। চরিত্র চিত্রন ও বাইরের দিক থেকে মহাকাব্যের উপযুক্তই মনে হয়। সাধারণ মানুষ মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য' এর চেয়েও একসময় বৃত্রসংহার কাব্য বেশি পছন্দ করেছিলেন।
দেবতাদের স্বদেশভূমি ফিরে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম এবং অশুভ শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রেমের জাগরণ ঘটাতে চেয়েছেন হেমচন্দ্র। এই কাব্যের মূল নীতি হল Poetic Justice বা ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়। হেমচন্দ্র চিরাচরিত ন্যায়নীতি ও মনুষ্যধর্মকে মেনে চলার জন্য বাঙালীর কাছে এই মহাকাব্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও তরুন বয়েসে এই কাব্যের প্রভাবে মেঘনাদবধ কাব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি তরুন বয়েসে মধুসূদনের মহৎ প্রতিভা অনুধাবন করতে পারেননি।
কাব্য কাহিনি ও বিষয় সন্নিবেশে মহাকাব্যের উপযোগী হলেও চরিত্র অঙ্কনে হেমচন্দ্র মধুসূদনকে এত বেশি অনুসরণ করেছেন যে মৌলিকতার প্রকাশ তেমন ঘটেনি। 'ঐন্দ্রিলা' চরিত্রটি ছাড়া প্রায় সব চরিত্রই মেঘনাদবধ কাব্যের কোন না কোন চরিত্রের অনুকরণ। রচনারীতির দিক থেকেও হেমচন্দ্র কোন অভিনবত্ব দেখাতে পারেননি। মধুসূদনের মতো তিনিও অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এই ছন্দের স্বরূপ তিনি ধরতে পারেননি। মধুসূদন যেমন মানব জীবন সম্বন্ধে কতগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও তত্ত্বের অবতারনা করেছিলেন যার সঙ্গে বিশ্ব প্রতিভার যোগাযোগ আছে। হেমচন্দ্রের কাব্যে সেসব কিছু নেই।
'মধুসূদনের পাশে নিষ্প্রভ' - একথা স্বীকার করতেই হয়। তবু হেমচন্দ্রকে ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয়। মধুসূদনের পর হেমচন্দ্র এবং তারপর নবীনচন্দ্র- এই তিন জন ছাড়া আর কেউ মহাকবির সম্মান পাননি। সেকালের পাঠকদের কাছে হেমচন্দ্র যতটা খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, নবীনচন্দ্র ততটা পাননি। যাই হোক, স্বল্পসংখ্যক বাংলা মহাকবিদের মধ্যে হেমচন্দ্রের স্থান মধুসূদন দত্তের ঠিক পরেই একথা বলাই যায়।