বাংলা গদ্য সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অবদান



ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতাব্দীর প্রাণ পুরুষ। উত্তুঙ্গ হিমালয় সাদৃশ ব্যক্তিত্ব, স্নেহকোমল হৃদয়, অখন্ড আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এই মানুষটি জাতীয় জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা- সর্বক্ষেত্রেই এক অটল মহিমা নিয়ে দণ্ডায়মান। তাঁর প্রচণ্ড পৌরুষ ও প্রশস্ত হৃদয় মানবতার ধর্মে দীক্ষা নিয়ে নরনারায়নের সেবায় উৎস্বর্গীকৃত হয়েছিল। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর অসাধারণ মনীষা, ধীর-শক্তি, সৃজনী শক্তি এক অসামান্য লাবন্যমণ্ডিত ও শিল্পসম্মত গদ্যরীতিরও সূচনা করেছিল। যার সাহায্যে পরবর্তীকালে সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যরচনার পথ সুগম হয়েছিল।


বিদ্যাসাগর সাধারণ অর্থে সাহিত্যিক ছিলেন না। ছিলেন সমাজ সংস্কারক। কিন্তু সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস সমস্ত বিষয়েই তিনি সচেতন ছিলেন। সমস্ত বিষয়ের উন্নতির জন্য তিনি চিন্তা ভাবনা করেছেন এবং বিভিন্ন রচনার মধ্যে তার প্রকাশও করেছেন তিনি। যে বিষয়ে চিন্তা প্রকাশ তিনি রচনার মাধ্যমে ঘটাতে চেয়েছেন তেমন রচনার উপযোগী গদ্য ভাষা তখন ছিল না। তিনি জানতেন পাঠকদের আকৃষ্ট করতে প্রচারের ভাষা সহজ হওয়া দরকার, সেই ভাষা তখন ছিল না বলেই তিনি নিজেই তা সৃষ্টিতে যত্নবান হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য তিনি সফলও হয়েছিলেন। 


১৮৪৭-১৯১৯ সময়পর্বে অনেকগুলি গ্রন্থের অনুবাদ তিনি করেছেন। তার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থটি হল 'বেতালপঞ্চবিংশতি'। এটি হিন্দি 'বৈতাল পচ্চীসীর' অনুবাদ। বিদ্যাসাগরের 'বেতালপঞ্চবিংশতি' গ্রন্থটি হিন্দি 'বৈতাল পচ্চীসী' গ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদ হলেও খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কালিদাসের 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম' নাটকের গদ্যানুবাদ করে তিনি রচনা করলেন 'শকুন্তলা'। ভবভূতির উত্তররামচরিত অবলম্বনে তিনি রচনা করলেন 'সীতার বনবাস'। শেক্সপিয়ারের *'Comedy of Errors' অবলম্বনে রচনা করলেন 'ভ্রান্তিবিলাস'। চেম্বার্স-এর 'Biography' অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন 'জীবনচরিত', 'Rudiments of Knowledge' অবলম্বনে লেখেন 'বোধোদয়'। ঈশপের 'Fables' অবলম্বনে রচিত হয়েছে 'কথামালা', 'আখ্যান-মঞ্জুরী'। এইসব গ্রন্থাদির অনুবাদ তিনি করেছেন। তাই বিদ্যাসাগরের অনুবাদকর্ম সত্যিকার সাহিত্যমর্যাদা লাভের দাবি রাখে।


মৌলিক রচনার ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের দান যথেষ্ট। আর 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৩) বাঙালীর লেখা বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস। 'বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার', 'বিধবা-বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' প্রভৃতি গ্রহগুলির মধ্যে বিদ্যাসাগর তথ্যের সমাবেশ এবং ক্ষুরধার ও অভ্রান্ত যুক্তির পরম্পর্য বিশ্লেষনের অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।


বিদ্যাসাগর প্রাঞ্জল ভাষায় সরস ভঙ্গিমায় বর্নিতব্য বিষয়কে পাঠকের উপভোগ্য করে তুলেছেন। ভাষাকে তিনি শিল্পের স্তরে উন্নীত করেছেন। মৌলিক রচনার ক্ষেত্রে তার আরও দুখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' এবং 'আত্মচরিত', 'প্রভাবতী সম্ভাষণ' - কোন এক বালিকা কন্যার মৃত্যু শোকের প্রতিবিম্বন। বিদ্যাসাগরের বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ের স্নেহধারা এর ছত্রে ছত্রে উৎসারিত হয়েছে।


বিদ্যাসাগর লঘু ব্যঙ্গমূলক রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। যারা নিন্দুক তাদের যুক্তিহীন কুৎসার জাল ছিন্নভিন্ন করতে তিনি ছদ্মনামে এই রচনাকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। সাধুগদ্যের শ্রেষ্ট শিল্পী বিদ্যাসাগরের এখানে অন্যমূর্তি। কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপোস্য এই ছদ্মনামে বিদ্যাসাগর তিনটি গ্রন্থ লিখেছেন। এগুলি হল- 'অতি অল্প হইল', 'আবার অতি অল্প হইল', এবং 'ব্রজবিলাস'।


বাংলা গদ্য ভাষায় ছেদ- যতি চিহ্নের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে সুমধুর গদ্যের কায়া নির্মাণে শ্রী দান করেছিলেন বলেই বাংলা সাহিত্যের গদ্যের জনক হলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন -


"বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজগতি ও কার্য কুশলতা দান করিয়াছেন।"



এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ