বাংলা কাব্য সাহিত্যে মধুসূদন দত্তের অবদান
বাংলা কাব্যে মধুসূদন দত্তের অবদান
⇒ বাংলায় সাংস্কৃতিক জীবনে যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়েছিল মানবতাবোধের দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করে, মাইকেল মধুসূদন সেই বোধের প্রথম সার্থক এবং সোচ্চার প্রবক্তা। সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মধুসূদনের পূর্বে ভারতচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্ত, রঙ্গলাল প্রভৃতি কবিদের কাব্যে আধুনিক যুগের মানুষ পরিতৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। সেই সংকটময় মুহূর্তে মধুসুদন তার বৈপ্লবিক চিন্তাধারা নিয়ে কাব্য জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন। পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে প্রাচ্য ভাবধারার মিলন সাধন করে তিনি যে নতুন কাব্যধারার প্রবর্তন করলেন, তাতে বাঙালী পাঠক যেমন বিস্মিত আবার তেমনি অনেকে এর বিরোধিতা করে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু ক্রমেই তার প্রতিভা স্বীকৃত হল। তিনি বাংলা সাহিত্যকে গ্রাম্যতার গণ্ডি কাটিয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
মহাকবি মধুসূদন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সত্যি এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি পাশ্চাত্য আদর্শে মহাকাব্য, আখ্যান কাব্য, পত্রকাব্য, গীতিকাব্য, প্রভৃতির সূচনা করে মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বাংলা কাব্যকে এক লাফে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন-
"সাত বছরের মধ্যে সত্তর বছরের ইতিহাস এগিয়ে দিলেন।"
তাঁর রচিত কাব্য গুলি হলো- 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' 'মেঘনাদবধ কাব্য', 'ব্রজাঙ্গনা কাব্য, 'বীরাঙ্গনা কাব্য', 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' ইত্যাদি।
১৮৬০ সালে রচিত 'তিলোত্তমাসম্ভব' এর উপাদান মধুসূদন সংগ্রহ করে ছিলেন মহাভারত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ উপাখ্যান থেকে। সুন্দ ও উপসুন্দ নামের দৈত্য ভ্রাতাদের বধ করার জন্য তিলোত্তমা নামে অপ্সরা সৃষ্টির কাহিনি কবিকে আকৃষ্ট করে, সেই- কাহিনিকে নিজের মতো সাজিয়ে চারটি সর্গে আখ্যানকাব্য রচনা করেন। এই কাব্যের বিশেষ লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য হলো কবি গতানুগতিক দৈব মহিমার পথ পরিহার করে প্রথম মানব মহিমার জয়গান করলেন। এখানেই অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রোতের প্রবাহ প্রথম লক্ষ করা যায়।
১৮৬১ সালে রচিত 'মেঘনাদবধ কাব্য' মধুসূদনের একটি যুগান্তরকারী সৃষ্টি। ৯ টি সর্গে সম্পূর্ণ মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণের পুত্র বীরবাহু নিধনের সংবাদ থেকে মেঘনাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। মূল রামায়ন থেকে কাহিনি অংশ নির্বাচিত হলেও এর প্রধান প্রধান চরিত্রগুলি যেমন- রাবণ, মেঘনাদ, প্রমীলা প্রভৃতি বাল্মীকির আদর্শ অনুসারে গঠিত হয়নি। আসলে বাল্মীকির পুরাকথার সূত্র ধরে মধুসূদন উনিশ শতকের নাগরিক বাংলার নবজাগরনের নতুন মূল্যবোধকে উৎসাহিত করার বিপ্লবী সাধনা করে গেছেন।
মধুসূদনের কাব্য প্রতিভার আর এক উজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া যায় তার রচিত ব্রজাঙ্গনা কাব্যে (১৮৬১)। এই কাব্যের বিষয়বস্তুর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো রাধার রূপান্তর সাধন; এবং মানবিক আবেগের যে অনবদ্য লিপিচিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষন করে। কাব্যগত দিক থেকে নিখুঁত কাব্য হল 'বীরাঙ্গনা কাব্য'। প্রসিদ্ধ রোমান কবি ওভিডের আদর্শে মধুসূদন এই কাব্যটি রচনা করেন। বাংলা কাব্যে এটি প্রথম পত্রকাব্য। ভারতীয় পুরাণ, মহাকাব্য ও নাটক থেকে কয়েকটি পরিচিত স্ত্রী চরিত্র নিয়ে তাদের লেখা কল্পিত চিঠির মধ্য দিয়ে কবি সেই সমস্ত বিচিত্ররূপিনী নারীর জীবন্ত মূর্তি অঙ্কন করেছেন। এই পত্রকাব্যগুলিতে আধুনিক বাস্তবনিষ্ঠ, প্রশ্নসংকূল, স্বয়ং স্বাধীন নারী জীবন প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে মধুসুদনের আরেক বিস্ময়কর অবদান 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' (১৮৬৬)। বাংলা সাহিত্যে এটাই প্রথম সনেট জাতীয় কবিতাবলী। পেত্রার্ক, শেক্সপিয়ার এবং মিলটনের অনুকরণে এই 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' রচনা করেছিলেন। তিনি সনেটের মধ্যে তার হৃদয় দুয়ার উন্মুক্ত করে অবরুদ্ধ ভাবরাশিকে অনাবৃত আলোকের মধ্যে মুক্তি দিয়েছিলেন। সংযত শব্দ যোজনা, আর ভাব কল্পনায় কবিতাগুলি বাংলা কাব্য জগতে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে।
মধুসূদনকে আমরা মহাকবি বলে জানলেও তার হৃদয়ের আন্তরালে বাস করছিল গীতিকবি। তার মহাকাব্য এবং অন্যকাব্যগুলির মধ্যেও গীতিরসের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সংস্কৃত ভাষার ভাব গাম্ভীর্য অন্যদিকে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের ধ্বনিসম্পদ ও ব্যঞ্জনা- এই দুয়ের সমন্বয়ে তার কাব্য উজ্জ্বল। এই সমস্ত কারণে বলা হয় যে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন। তাই কবিবন্ধু রাজনারায়ণ বসু কবিকে পরিয়েছিলেন অমরতার স্বর্ণমুকুট -