বাংলা কাব্যে নবীনচন্দ্র সেনের অবদান সম্পর্কে আলোচনা



বাংলা কাব্য সাহিত্যে নবীনচন্দ্র সেনের ভূমিকা কতখানি তা আলোচনা করো।


⇒ উনবিংশ শতাব্দীর এক বিস্ময়কর কবি চরিত্র হল নবীনচন্দ্র সেন। মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন কবি। নবীনচন্দ্র কবিত্ব শক্তি এবং ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বাংলাদেশের পণ্ডিত সমাজে আসামান্য প্রতিভা অর্জন করেছিলেন। কিশোর বয়স থেকে নবীনচন্দ্র সেন কাব্যচর্চা শুরু করেন। আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- 


“পাখীর যেমন গীতি, সলিলের তরলতা, পুষ্পের যেমন সৌরভ, কবিতানুরাগ আমার প্রকৃতিগত ছিল।"


কবির এই উক্তি থেকে বোঝা যায় কিভাবে তিনি কাব্যচর্চায় অনুপ্রানিত হয়েছিলেন।


নবীনচন্দ্র সেন মহাকাব্যের পরিকল্পনা করলেও তিনি ছিলেন আসলে গীতিকবি। প্রথম যৌবনে লেখা কবিতাগুলি সমস্তই ছিল গীতিকবিতা। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পূর্বে যদি কারো কবিতায় যথার্থ পাশ্চাত্য ধরনের গীতিকবিতার স্বাদ পাওয়া যায়, তবে তার কিছুটা নবীচন্দ্রের মধ্যেই পাওয়া যাবে। প্রধানত প্রেম ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই তার অধিকাংশ গীতিকবিতা রচিত হয়েছে।


নবীনচন্দ্র সেন কয়েকটি আখ্যানকাব্যের জন্য বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। 'পলাশীর যুদ্ধ', 'ক্লিওপেট্রা', এবং 'রঙ্গমতী' এই তিনখানি হচ্ছে তাঁর আখ্যান কাব্য। এগুলির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ পাল আমলের কাহিনি বলে বাংলা পাঠক সমাজে অধিকতর পরিচিতি। রচনার দিকে থেকেও এর কোন কোন অংশ খুবই উল্লেখযোগ্য; মতিলাল ঘোষের প্রভাবে তিনি পলাশীর যুদ্ধকে অবলম্বন করে ইতিহাস মিশ্রিত স্বদেশী আখ্যানকাব্য রচনা করেন। ক্লিওপেট্রায় কবি বিশেষ কোন প্রতিভার সাক্ষর রেখে যেতে পারেননি। 'রঙ্গমতী' কাল্পনিক রোমান্টিক দেশপ্রেমের কাহিনি। পলাশীর যুদ্ধে পরিচিত ইতিহাস থাকায় পাঠক সমাজে তা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু 'রঙ্গমতী' সম্পূর্ণ কাল্পনিক দেশপ্রেমের আবেগ উচ্ছ্বাস হওয়ায় তার দ্বারা নবীনচন্দ্র কোন খ্যাতি পাননি।


১৮৮৭-১৮৯৬ সালের মধ্যে নবীনচন্দ্রের তিনখানি পৌরাণিক আখ্যানকাব্য মহাকাব্যের বিশাল পটভূমিকায় প্রকাশিত হয়। এগুলি হলো- 'রৈবতক'(১৮৮৭), 'কুরুক্ষেত্র'(১৮৯৩), এবং 'প্রভাষ'(১৮৯৬) কৃষ্ণের জীবন কথাই এই তিনটি কাব্যের অবলম্বন। তিনি কৃষ্ণের জীবনকে ভিত্তি করে সমকালীন ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তিন খন্ডে সমাপ্ত এই বিশাল মহাকাব্যের সূচনা করেন। প্রথম খন্ডে কৃষ্ণলীলার আদিপর্ব, দ্বিতীয় খণ্ডে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পটভূমিকায় অভিমুন্যের শোচনীয় মৃত্যু ও তৃতীয় খন্ডে যদুবংশের ধংস এবং কৃষ্ণের দেহত্যাগ বর্ণিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন যে, নবীনচন্দ্র এই আখ্যানকাব্য গুলিতে পাশ্চাত্য আদর্শে উনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভাবধারা গুলিকে সংযোজিত করেছেন। এই কাব্য- গুলিতে কবির কতগুলি মৌলিক পরিকল্পনা প্রশংসনীয়, আধুনিক ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র ও সমাজ এবং রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি আদর্শকে তিনি কৃষ্ণের জীবনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণকে দিয়ে তিনি ভাবি ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্য প্রচার করিয়ে নিয়েছেন।


নবীনচন্দ্রের অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে কয়েকটি মহাপুরুষের জীবনীকাব্য খ্রীষ্ট, অমিতাভ, অমৃতাভে উল্লেখযোগ্য। খ্রীষ্ট, বুদ্ধ এবং চৈতন্যদেবের জীবনীকাব্য রচনা করতে চাইলেও অমৃতাভে চৈতন্য জীবনী শেষ হয়নি । কিন্তু পাঁচখণ্ডে সমাপ্ত 'আমার জীবন' (১৩১৬-১৩২০ বঙ্গাব্দ) বাংলার আত্মজীবনীমূলক অমূল্য সম্পদ।


পরিশেষে বলা যায় যে, মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির তুলনায় নবীনচন্দ্রের রচনাগুলি উচ্চ আসন দাবী করতে পারে না ঠিকই তবুও এই দুই মহাকবির মধ্যবর্তী সময়ে হেমচন্দ্রের মতোই নবীনচন্দ্র যুগ চেতনার প্রতিফলনে তাঁর সৃষ্ট কাব্যের প্রতি সাধারণ পাঠকদের শ্রদ্ধা আকর্ষন করতে পেরেছে, এখানেই নবীনচন্দ্রের কবি প্রতিভার মৌলিকতা।



এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ