পশ্চিমবঙ্গের নদনদী
পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে অসংখ্য নদনদী দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমের অভিমুখে প্রবাহিত। হয়েছে। শিরা-উপশিরার ন্যায় নদনদীগুলি ছড়িয়ে রয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গকে বলা যায় নদীমাতৃক রাজ্য। নদনদী গুলি হয় উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে অথবা ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থান, উৎপত্তিস্থল, প্রবাহের অভিমুখ প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গের নদনদীগুলিকে প্রধানত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
(ক) গঙ্গা ও ভাগীরথী-হুগলি নদী।
(খ) উত্তরবঙ্গের নদনদী।
(গ) ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে সৃষ্ট বা ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডান তীরের নদনদী সমূহ।
(ঘ) ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের নদনদী সমূহ।
(ঙ) সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদী।
(ক) গঙ্গা ও ভাগীরথী-হুগলি নদী :
উত্তরাঞ্চলের কুমায়ুন হিমালয় থেকে সৃষ্টি হয়ে উত্তরপ্রদেশ, বিহার রাজ্য অতিক্রম করে গঙ্গা নদী পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবেশ করেছে। মুর্শিদাবাদে পূর্ব অভিমুখে কিছুদূর প্রবাহিত হওয়ার পর ধূলিয়ানের নিকট গঙ্গা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। প্রধান শাখাটি পদ্মানামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অপ্রধান শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নামে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে দক্ষিণ অভিমুখে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) ধূলিয়ান থেকে নদিয়া জেলার নবদ্বীপ পর্যন্ত নদীটি ভাগিরথী এবং নবদ্বীপের দক্ষিণ অংশে হুগলি নামে পরিচিত।
(ii) হিমবাহগলা জলে পুষ্ট হওয়ায় নদীটি নিত্যবাহী নদী।
(iii) নদীটিতে অসংখ্য নদী বাঁক সৃষ্টি হয়েছে।
(iv) ভাগীরথী-হুগলি নদীতে, বিশেষত হুগলি নদীতে একাধিক নদীচর গড়ে উঠেছে।
(v) এই নদীর দক্ষিণ অংশে জোয়ার-ভাঁটার প্রকোপ দেখা যায়।
(খ) উত্তরবঙ্গের নদনদী :
গঙ্গা নদীর উত্তর অংশে প্রধানত দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ জেলার ওপর দিয়ে যে সমস্ত নদনদীগুলি প্রবাহিত হয়েছে, তাদের বলা হয় উত্তরবঙ্গের নদনদী। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান নদীগুলি হল তিস্তা, তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা, বালাসন, মেচি, রঙ্গিত, মহানন্দী, কালিন্দি প্রভৃতি।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) নদীগুলি হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং বরফগলা জলে পুষ্ট।
(ii) পার্বত্য অংশে নদীগুলি গভীর গিরিখাত সৃষ্টি করেছে এবং যথেষ্ট খরস্রোতা।
(iii) সমভূমি অঞ্চলে সঞয়জনিত কারণে নদীগর্ভের গভীরতা হ্রাস পেয়েছে।
(iv) উত্তরবঙ্গের নদীগুলি বন্যাপ্রবণ। প্রথমত, বরফগলা জল। দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত বৃষ্টির জল। তৃতীয়ত, নদীর গভীরতা হ্রাস এবং চতুর্থত, ভূমির ঢাল খুব কম থাকায় নদীগুলিতে প্রত্যেক বছরই বন্যা দেখা যায়।
(v) নদীগুলি বাংলাদেশে প্রবেশ করে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
• তিস্তা নদী :
তিস্তা উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। নদীটি সিকিম রাজ্যের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের জেমু হিমাবাহ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৩০১ কিলোমিটার। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশের রংপুরের নিকট যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পের পূর্বে নদীটি বরেন্দ্রভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হত।
(গ) ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে সৃষ্ট বা ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডান তীরের নদনদীসমূহ :
ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডান তীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ওপর দিয়ে যে সমস্ত নদনদীগুলি প্রবাহিত হয়েছে, তাদের বলা হয় ভাগীরথী-হুগলি নদীর ডানতীরের নদনদীসমূহ। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান নদনদীগুলি হল অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, ব্রাহ্মণী, কংসাবতী, দারকেশ্বর, শিলাবতী, কেলেঘাই, রূপনারায়ণ, হলদি, সুবর্ণরেখা প্রভৃতি।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) নদীগুলি প্রধানত ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এবং বৃষ্টির জলে পুষ্ট।
(ii) মালভূমি অংশে নদীগুলি খরস্রোতা এবং সমভূমিতে নদীগুলি ধীরপ্রবাহী।
(iii) নদীগুলির নিম্ন অংশ বন্যাপ্রবণ।
(iv) সুবর্নরেখা ছাড়া বাকি নদীগুলি ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পড়েছে।
• দামোদর নদ :
দামোদর এই অঞ্চলের প্রধান নদ। দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৪১ কিলোমিটার। নদীটি সৃষ্টি হয়েছে ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার পাহাড়ি অঞ্চলের খামারপত শূন থেকে। ঝাড়খণ্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বর্ধমান ও পুরুলিয়া জেলার সীমান্তবরাবর পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি ও হাওড়া জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফলতার নিকট ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পড়েছে। দামোদরের প্রধান উপনদী হল বরাকর, বোকারো, কোনার এবং প্রধান শাখা নদী হল মুক্তেশ্বরী নদী। মুণ্ডেশ্বরী নদীটি রূপনারায়ণ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
(ঘ) ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের নদীসমূহ :
ভাগীরথী-হুগলি নদীর বামতীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কতকগুলি স্বল্প দৈর্ঘ্যসম্পন্ন নদনদী প্রবাহিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য নদীগুলি হল – ভৈরব, জলঙ্গী, মাথাভাঙা, চূর্ণি, ইছামতী প্রভৃতি।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) এই নদীগুলি পদ্মা থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং ভাগীরথী-হুগলি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে (ইছামতীবাদে)।
(ii) নদীগুলিতে সারাবছর জল থাকে।
(iii) নদীগুলি বর্ষাকালে ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্লাবিত করে।
(ঙ) সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদীসমূহ :
ভাগীরথী-হুগলি নদী অসংখ্য শাখায় বিভক্ত হয়ে অবশেষে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এই সমস্ত নদনদীগুলিকে বলা হয় সুন্দরবন অঞ্চলের নদনদী। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদীগুলি হল সপ্তমুখী, গোসাবা, মাতলা, বিদ্যাধরী, পিয়ালী, ঠাকুরান, রায়মঙ্গল, ইছামতী, কালিন্দি প্রভৃতি।
• বৈশিষ্ট্য :
(i) নদীগুলিতে সারাবছরই জল থাকে।
(ii) দৈর্ঘ্য খুবই কম।
(iii) নদীগুলি জোয়ারের জলে পুষ্ট; ফলস্বরূপ নদীগুলির জল কিছুটা লবণাক্ত।
(iv) নদীগুলিতে খাঁড়ির সৃষ্টি হয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন