পশ্চিমবঙ্গের ঋতুচক্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে চারটি ঋতুর বিশেষ প্রাধান্য দেখা যায়। যথা— 


(i) গ্রীষ্মঋতু : 

মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রীষ্ম ঋতু থাকে। সূর্যরশ্মির পতন কোণ ও পতনকাল বেশি থাকায় এই সময় উন্নতার পরিমাণ বেশি হয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রীষ্মকালীন গড় উচ্চতা হয় প্রায় ৩০° সেন্টিগ্রেড। তবে অঞ্চলভেদে উন্নতার পার্থক্য দেখা যায়। বর্ধমানের পশ্চিমাংশ, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় উন্নতা 80°C-85°C সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হয়। আবার উচ্চতার কারণে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের উষ্ণতা ১৫°C-২০°C সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপকেন্দ্রের সৃষ্টি হওয়ায় গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ বঙ্গে ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত ঘটে। একে বলা হয় কালবৈশাখি।

(ii) বর্ষা ঋতু :

জুন থেকে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গে বর্ষা ঋতু থাকে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা ঋতুর সূচনা হয়। আর্দ্র এই বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টিপাত ঘটে। এই বায়ুর প্রভাবে বর্ষাঋতুতে প্রায় ১৫০ সেমির মতো বৃষ্টিপাত হয়। তবে অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতের তারতম্য ঘটে। যেমন দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৩০০-৪০০ সেমি বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু পুরুলিয়ায় বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ১২৫ সেমি বা তার কম। অনেক সময় বর্ষা ঋতুতে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে উপকূলবর্তী অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হয়।

(iii) শরৎ ঋতু : 

অক্টোবর ও নভেম্বর এই দুমাস পশ্চিমবঙ্গে শরৎ ঋতু বিরাজ করে। সূর্যরশ্মির পতনকোণ ও পতনকালের পরিমাণ কমে যাওয়ায় উষ্ণতা কম থাকে। এই ঋতুতে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সংঘাতে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে ঝড় ও সামান্য বৃষ্টিপাত ঘটে। এই ঝড়কে বলা হয় আশ্বিনের ঝড়। স্বল্পস্থায়ী এই ঋতু যথেষ্ট আরামদায়ক।

(iv) শীত ঋতু : 


পশ্চিমবঙ্গে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিনমাস শীত ঋতু বিরাজ করে। এই সময়ে শীতল উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এই শীতল বায়ুর প্রভাবে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের গড় উষ্ণতা হ্রাস পায়। পার্বত্য অঞ্চলে উয়তা ১-২° সেন্টিগ্রেড এবং দক্ষিণবঙ্গের গড় উষ্ণতা ১০°-১৫° সেন্টিগ্রেড হয়। শুষ্ক প্রকৃতির উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয় না তবে দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত ঘটে থাকে।

• পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য :


পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল : 

(i) গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা থাকে ১৫-২০% সেন্টিগ্রেড। তাই এই সময়ে পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু আরামদায়ক।

(ii) শীত ঋতুতে প্রবল শৈত্যপ্রবাহের কারণে এই অঞ্চলের উষ্ণতা ১°-২° সেন্টিগ্রেডে নেমে যায়। সুতরাং শীতকালীন জলবায়ু খুব কষ্টদায়ক।

(iii) দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমিবায়ুর প্রভাবে পার্বত্য অঞ্চলে পর্যাপ্ত শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটে। এই অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০০-৪০০ সেমি। সর্বাপেক্ষা বর্ষণসিক্ত অঞ্চল হল জলপাইগুড়ি জেলার ‘বক্সাদুয়ার' (৪৫০ সেমি.)।

(iv) শীত ঋতুতে পার্বত্য অঞ্চলের কিছু অংশে উয়তা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যায় এবং মাঝে মাঝে তুষারপাত ঘটে।

• উপকূলীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য :


পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল হল উপকূলবর্তী অঞ্চল। এই অঞ্চলের জলবায়ুতে সমুদ্রের প্রভাব কার্যকরী হওয়ায় জলবায়ু কিছুটা সমভাবাপন্ন প্রকৃতির হয়েছে। এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন গড় উয়তা ৩০°সেন্টিগ্রেড এবং শীতকালীন গড় উন্নতা ১৫°-১৮ সেন্টিগ্রেড হয়। আর্দ্র সামুদ্রিক বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বেশি হয়। গ্রীষ্ম ও শরৎ ঋতুতে ঘূর্ণবাত জনিত কারণে এই অঞ্চলে ঝড় ও বৃষ্টিপাতের প্রভাব দেখা যায়। গ্রীষ্মকালীন ঝড় ‘কালবৈশাখী এবং শরৎকালীন ঝড় আশ্বিনের ঝড়' নামে পরিচিত।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন