দীনেশ দাস সমাজ সচেতন কবি, তার কাস্তে কবিতাটি নিঃসন্দেহে একটি প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতা। বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের পটভূমিকায় কবিতাটি রচিত হয়েছিল। কবি ছিলেন বামপন্থী কর্মী ও লেখক। সে সময় কৃষক আন্দোলনের আহ্বান এই কবিতার ছন্দে মূর্ত হয়েছে। তেভাগা আন্দোলন রয়েছে এই কবিতাটির প্রেক্ষাপটে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে রচিত এই কবিতায় এই যুগের যুগসংকট আভাসিত হয়েছে।
কৃষকের ফসল রক্ষার আন্দোলন গড়তে হয়েছিল জমিদার, জোতদার এবং তাদের সহায়ক বিদেশি শাসক ও প্রশাসন-যন্ত্রের বিরুদ্ধে। এমনকি কৃষক তার ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তার উৎপাদনের আদিম যন্ত্র কাস্তেটাকেই হাতিয়ার করে এই প্রতিবাদী সংগ্রামে নেমেছিল। যে কাস্তে দিয়ে কৃষক তার পাকা ফসল মাঠ থেকে তোলে সেই কাস্তেকেই অস্ত্র করে তার ফলানো ফসলের উপর নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইতে নেমেছিল। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শরীরের রক্ত জল করে ফসল ফলায় সেই কৃষকদের এই সংগ্রামের ক্ষেত্রে কবি দীনেশ দাস এই কবিতায় আহ্বান জানিয়েছেন।
শাসকের বেয়নেট যতই ধারালো হোক, কৃষকদের এই প্রতিরোধ ভাঙতে তারা যতই এগিয়ে আসুক না কেন, প্রতিরোধের দেয়াল তুলে এই প্রতিরোধের সংগ্রামে সংগ্রামী বন্ধু কৃষকদের সামিল হতে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
বেয়নেট হোক যত ধারালো—
কাস্তেটা ধার দিয়ো, বন্ধু!
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিয়ো, বন্ধু।
কবি বলতে চেয়েছেন আজকে বাঁচার এই কঠিন সংগ্রামের মুহূর্তে পলায়নী মানসিকতায় জীবন সংগ্রামে বিমুখ হয়ে সৌন্দর্য্য-আশ্রয়ী হওয়া যাবে না। এই সংগ্রামে জয়ের লক্ষ্য স্থির রেখে হাতের এই যন্ত্র দিয়েই রুখে দাঁড়াতে হবে। শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে। কাজেই আকাশের চাঁদ নয়, মাটির কাস্তেই হোক আজ সংগ্রামী কৃষকদের কাছে বরণীয়। তাই কবি বলেছেন-
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ’লো কাস্তে!
মার্কসীয় তত্ত্বে বলা হয়েছে দুনিয়াব্যাপী পুঁজিবাদ তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ, শিল্পদ্রব্য বিক্রয়ের বাজার সৃষ্টি ও সেই বাজার অধিকার করার স্বার্থে নিজেদের মধ্যেই তারা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। মহাযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে মার্কস কথিত এই বক্তব্যেরই ঐতিহাসিক উদাহরণ। বাজারের দখল ও কাঁচামালের ক্ষেত্র নিয়ে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। ধনতান্ত্রিক দেশগুলি তাদের অর্থনীতির স্বার্থেই অস্ত্রের পাহাড় বানিয়েছিল। কবি এই কবিতায় বলেছেন-
ইস্পাতে কামানেতে দুনিয়া
কাল যারা করেছিল পূর্ণ,
কামানে-কামানে ঠোকাঠুকিতে
আজ তারা চূর্ণবিচূর্ণ।
সংগ্রামী মানুষের রক্ত ও আত্মত্যাগের মধ্যদিয়েই জীবনের জয় ঘোষিত হয়। বিধ্বস্ত এই পুঁজিবাদী যুগের শেষে শেষপর্যন্ত মাটির মানুষের যুগ প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই কবির বিশ্বাস।
আধুনিক কালের যে সমাজ সচেতনতা ; অন্যায় শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রামী মনোভাব প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বাংলায় আমরা দেখতে পেয়েছি, কবিতাটিতে সেই মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। বামপন্থী কাব্যধারায় এই যুগমানসকেই রূপ দেবার সূচনা হয়েছিল। কবি বিমল ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখের মধ্য দিয়ে এই ধারারই প্রসারিত রূপ আমরা দেখতে পাই। এদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও রাজনীতি চর্চার সঙ্গে আপন কবি প্রতিভার যোগেই কবিতাগুলি রাজনৈতিক প্রচারসর্বস্ব না হয়ে, হয়ে উঠেছে কবিতা। আর প্রতিভার যোগেই দীনেশ দাসের 'কাস্তে' কবিতাটি একটি সার্থক কবিতা হয়ে উঠেছে।
আধুনিক কবিতায় মনন ও কল্পনার সংহত প্রকাশ মাধ্যম হল চিত্রকল্প বা ইমেজ। চাঁদের বাঁকা ফালির চিত্রকল্প কাস্তের কল্পনা একটা সংগ্রামী আমেজ এনে দিয়েছে। শুধু তাই নয় কৃষকের ব্যক্তিগত সংগ্রামকে আকাশের চাঁদের উল্লেখের মধ্যদিয়ে এই সংগ্রাম ভাবনাকে ঊর্ধ্বমুখী সর্বজনীন স্তরে উন্নীত করেছেন কবি। চাঁদের ফালির সঙ্গে কাস্তের ফালির তুলনায় এক চমৎকার চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে। এই চিত্রকল্পগুলির সাহায্যে কবি বর্তমান সমাজের সংঘাত-সংকুল সমস্যাপীড়িত জীবনের চমৎকার ব্যঞ্জনাময় শব্দরূপ নির্মাণ করেছেন এবং এর ফলেই কবিতাটি এক অনবদ্য কবিতা হয়ে উঠেছে।
Bonus Knowledge 🙂
জীবনানন্দ দাশ ধূসর পান্ডুলিপি গ্রন্থের পিপাসার গান কবিতায় সর্বপ্রথম চাঁদের সঙ্গে কাস্তের তুলনা করেছেন। আর দীনেশ দাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে তাদের একটি করে কবিতায় চাঁদ ও কাস্তের তুলনা করেছেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন