ভূমিকা
প্রকৃতির রাজ্যে এক বিশিষ্ট উপাদান জনগোষ্ঠী বা মানুষ। মানুষ সৃষ্টি করে ইতিহাস। তাই ইতিহাসের ওপর প্রকৃতি বা ভূগোলের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভূগোল ও ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের ইতিহাস ও সভ্যতার বিকাশেও ভৌগলিক প্রভাব ব্যাপক।
■ হিমালয়ের প্রভাব :
প্রথমত, মিশরকে যদি নীল নদের দান বলা যায়, ভারতবর্ষকেও হিমালয়ের সন্তান বলা যেতে পারে। কারণ, হিমালয় ভারতের রক্ষাকর্তা। বর্তমানে মহাকাশযান যুগে প্রাকৃতিক প্রাচীরের কথা আজগুবি মনে হলেও হিমালয় প্রাচীনকালে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ভারতবর্ষকে নিরাপদ রেখেছিল।
দ্বিতীয়ত, হিমালয় ভারতের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক। দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর নিয়ন্ত্রণের ফলে একদিকে মধ্য এশিয়ার শৈত্যপ্রবাহ থেকে ভারত রক্ষা পেয়েছে, অন্যদিকে বারিপাতের ফলে এদেশ হয়েছে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা।
তৃতীয়ত, হিমালয় থেকে বহু নদ-নদীর উৎপত্তি হয়েছে। এদের ওপর উত্তর ভারতের কৃষি ব্যবস্থা নির্ভরশীল। নদীপথে যাতায়াত ব্যবস্থা থাকায় ব্যাবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে শহর- বন্দর। বারাণসী, রাজগীর, পাটলিপুত্রের মতো শহরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
চতুর্থত, উত্তর-পশ্চিম ভারতের হিমালয়ের খাইবার ও বোলান গিরিপথ দিয়ে গ্রিক, শক, কুষাণ, হন, তুর্কি, মোঙ্গল এবং উত্তর-পূর্বের অহম, বর্মি ভারতে এসে রাজত্ব করেছে, ভারতীয় জন-জীবনে একাত্ম হয়েছে। ভারতবাসীও এই পথে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
পঞ্চমত, ভারতবাসীর ধর্মীয় জীবনেও হিমালয়ের দান প্রচুর। হিমালয় হল ভারতীয় ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতীক।
ষষ্ঠত, হিমালয় পর্বতমালাই এশিয়া মহাদেশ থেকে ভারতবর্ষকে কিছুটা পৃথক করে এদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক নিজস্ব সত্তা।
■ বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাব :
প্রথমত, ভারতবাসীর ওপর বিন্ধ্য পর্বতের প্রভাবও কম নয়। ভারতের ঠিক মধ্যস্থানে প্রাচীরের
মতো অবস্থানের ফলে বিন্ধ্য পর্বত উত্তর-দক্ষিণের মিলনের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। ফলে দাক্ষিণাত্যের
দ্রাবিড় সভ্যতা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হতে পেরেছিল।
দ্বিতীয়ত, উত্তর ভারতের মতো সর্বদা আক্রমণকারীদের সম্মুখীন হয়নি বলে স্থিতিশীল জীবনযাত্রা ও ব্যাবসা-বাণিজ্যে দক্ষিণী মানুষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল।
তৃতীয়ত, পরবর্তীকালে উত্তর-দক্ষিণের সার্বিক যোগাযোগ হওয়ায় উত্তর-দক্ষিণের মিশ্র সভ্যতা
ভারতের ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
■ নদ-নদীর প্রভাব :
ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি—সর্বক্ষেত্রেই নদ-নদীর প্রভাব অনুভূত হয়।
প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ হয় সিন্ধু নদের তীরে। আর্য সভ্যতা গড়ে ওঠে পঞ্চ নদের তীরে ও গাঙ্গেয় উপত্যকায়।
দ্বিতীয়ত, নদী উপত্যকার কৃষি জমি নিয়ে যে রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয় তাও ভারত ইতিহাসকে প্রভাবিত করে।
তৃতীয়ত, নদী উপত্যকার শহরগুলি, যথা—হস্তিনাপুর, বারাণসী, পাটলিপুত্র রাজনৈতিক আবর্তের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।
চতুর্থত, নদীগুলি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্র হওয়ায় বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম হয়, ফলে ইতিহাস এক বিশেষ রূপ ধারণ করে।
■ সমুদ্রের প্রভাব :
সমুদ্রও ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে।
প্রথমত, দাক্ষিণাত্যের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূল একরকম সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বলে উপদ্বীপ এলাকা একটা স্বাভাবিক নিরাপত্তা লাভ করেছে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের বহির্বাণিজ্যের প্রধান উৎস আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর। ভারতের সমুদ্র উপকূলে অসংখ্য বন্দর গড়ে উঠেছিল ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রসারে।
তৃতীয়ত, ব্যাবসা-বাণিজ্যের সূত্রেই ভারতীয় সভ্যতা প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চম্পা, যবদ্বীপ প্রভৃতি কেন্দ্রে ।
চতুর্থত, সমুদ্র সান্নিধ্যের জন্যে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জাতিগুলি নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। পঞ্চমত, সমুদ্র পথেই ইংরেজ বণিকেরা ভারতবর্ষে এসে অর্থনৈতিক শোষণ শুরু করে। আবার তাদের আগমনের ফলেই ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্যের প্রভাব পড়ে।
■ উপসংহার :
প্রকৃতি ভারতকে সম্পদশালী করেছে। প্রকৃতির অকৃপণ দানে এই উপমহাদেশের জনজীবনে এসেছে বৈচিত্র্য । উত্তর ভারতের নদী-উপত্যকার পলিমাটিতে কম পরিশ্রমে কৃষিকার্যের দ্বারা স্বচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হওয়ায়, প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের লোকেরা দার্শনিক চিন্তা, সাহিত্য রচনা ও ধর্মনীতি রচনায় বেশি উদ্যম দেখায়। গঙ্গা ও সিন্ধু নদের তীরে ভারতের প্রাচীন সভ্যতা গড়ে ওঠে। এই সময়ে আধ্যাত্মিকতা, মননশীলতা তথা দার্শনিক চিন্তায় ভারতবর্ষ পৃথিবীখ্যাত হয়ে ওঠে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন