ভূগোলের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনা

• ভূগোলের অর্থ (Meaning of Geography) : 


ভূগোলের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Geography' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন গ্রিক পণ্ডিত এরাটোসথেনিস্ (Era- tosthenes)। দুটি গ্রিক শব্দ যথা— 'Ge' ও 'Graphien'-এর মিলনে Geography শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। Ge কথার অর্থ হল Earth বা পৃথিবী এবং 'Graphien' কথাটির অর্থ হল বর্ণনা। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে ভূগোল হল পৃথিবীর বর্ণনা। ভূগোল হল ক্ষেত্রীয় বিজ্ঞান। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশ বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং ওই দুই পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করা হয় যে বিষয়ে, সেটাই হল ভূগোল। প্রাচীনকালে গ্রীক পণ্ডিত স্ট্যাবো-এর মতে পৃথিবীর জলভাগ ও স্থলভাগ এবং সেই অঞ্চলে বসবাসকারী জীবকূল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। যে বিষয়ে, তাহাই হল ভূগোল। ব্রিটিশ ভৌগোলিক উল্ডরিজ ও মরগ্যানের মতে ভূগোলে ভূতল ও মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

• প্রকৃতি (Nature) : 


ভূগোলের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা ভূগোলবিদদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রাচীনকাল থেকে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভূগোলের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীনকালে ভূগোলবিদ ও পণ্ডিতদের মতে পৃথিবীর আকৃতি, জলভাগ ও স্থলভাগের কণ্টন, ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য এবং পৃথিবীর জীবকূলের বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ করাই হল ভূগোলের কাজ। প্রাচীন গ্রিক পণ্ডিত স্ট্র্যাবো (Strabo), টলেমি (Ptolemy) প্রমুখরা এই তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। এই সময়ে ভূগোল তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা শাস্ত্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বিজ্ঞানী ভ্যারেনিয়াস (varenius) ভূগোল সম্পর্কে বলেন যে সীমিত অর্থে ভূগোল হল কয়েকটি দেশের বর্ণনা, আর ব্যাপক অর্থে ভূগোলকে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা যে কোনো দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক সংবিধান পর্যন্ত ভূগোলের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং ভ্যারেনিয়াস-ই প্রথম ভূগোলকে প্রাকৃতিক ভূগোল ও মানবীয় ভূগোলে ভাগ করেছিলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)-এর হাত ধরেই সমাজবিজ্ঞান থেকে ভূগোল ও ইতিহাস বিজ্ঞানের দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে বেরিয়ে আসে। কান্টের মতে দৈশিক ঘটনাগুলি বিশ্লেষণের কাজ হল ভূগোলের, আর ইতিহাসের কাজ হল কালের (temporal sequence) ক্রমপর্যায় আলোচনা করা। আধুনিক ভূগোলের জয়যাত্রার সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। জার্মান পণ্ডিত আলেকজান্ডার ভন হামবোল্ড (Alexander von Humboldt) ও কার্ল রিটার (Carl Ritter) ছিলেন এর পথিকৃৎ। হামবোল্ডের মতে, ভূগোল হল আদি বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিজ্ঞান যাতে পৃথিবীতে প্রাপ্ত সমস্ত জিনিসের (things) সমীক্ষা ও বর্ণনা করা হয়। রিটারের মতে ভূগোলের মূল বিষয় হল প্রাকৃতিক পরিবেশের সকল বিষয় এবং তার সঙ্গে মানবজাতির সম্বন্ধ বিশ্লেষণ করা। পরবর্তী সময়ে হার্টশোন, স্কিফার, উন্ডরিজ মরগ্যান, ভিদান দ্য লা রাশ প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ ভূগোলকে আর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যান। হার্টশোনের মতে, ভূগোলে পৃথিবী পৃষ্ঠের বৈচিত্র্যময় রূপকে সঠিকভাবে, পর্যায়ক্রমে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করা হয়। স্কিফারের মতে ভূগোল হল দৈশিক বিজ্ঞান, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের বিশেষ বিশেষ বিষয়কে সুস্পষ্ট ও যুক্তির ভিত্তিতে তুলে ধরা হয়। ভিদাল দ্য লা রাশের মতে ভূগোল হল স্থানের বিজ্ঞান, মানুষের বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানী ট্রিওয়ার্থা (Trewartha) ও পিটার হ্যাটে (Peter Haggett) ভূগোলে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র এবং সাম্প্রতিককালে স্মিথ (Smith) মানবতাবাদী ভূগোলের কথা উল্লেখ করেন। স্মিথের মতে, দৈশিক বিষয়ের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াকর্মের সম্পর্ক তুলে ধরা হয় ভূগোলে। ভৌগোলিক পিট (Peet) মার্ক্সীয় ভূগোলের ধারণা উত্থাপন করেন। তাঁর মতে ভূগোল সামাজিক প্রক্রিয়া ও দৈশিক প্রক্রিয়াগুলির পারস্পরিক সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে।

• ভূগোলের পরিধি (Scope of Geography) : 


ভূগোলের পরিধি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভূগোলবিদদের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভৌগোলিকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভূগোলের প্রকৃতি বিশ্লেষণের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিধি ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ভূগোলের বিষয়বস্তু কিন্তু দুটি মুখ্য উপাদানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। যথা— 

(১) প্রাকৃতিক পরিবেশ 
(২) মানবগোষ্ঠী

প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবগোষ্ঠীর জটিলতা ও পরিবর্তনশীলতা যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যত বৃদ্ধি পেয়েছে তত ভূগোলের পরিধি বিস্তার লাভ করেছে। ভূগোল প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রাকৃতিক ভূগোল ও মানবীয় ভূগোল এই দুই শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশ্লেষণ ও মানবগোষ্ঠীর উপর তার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে করতে প্রাকৃতিক ভূগোল বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। যেমন— ভূবিদ্যা, ভূমিরূপবিদ্যা, জলবায়ুবিদ্যা, মৃত্তিকাবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিষয়ক ভূগোল, প্রাণীবিষয়ক ভূগোল, পরিবেশবিদ্যা প্রভৃতি। সুতরাং প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। অপরদিকে ভৌগোলিকরা মানবগোষ্ঠীর সামগ্রিক কাঠামোর এক একটি দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণের কাজ করায় মানবীয় ভূগোল সমৃদ্ধি লাভ করে ও এর পরিধি বিস্তৃত হয়। মানবীয় ভূগোল বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে যথা—সামাজিক ভূগোল, ঐতিহাসিক ভূগোল, জনসংখ্যা বিষয়ক ভূগোল, রাজনৈতিক ভূগোল, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ভূগোল প্রভৃতি। সুতরাং ভূগোলের বিষয়বস্তু বিশাল এবং সতত পরিবর্তনশীল।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন