রূপকথা কাকে বলে?

লোককথার বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে সমৃদ্ধতর হল রূপকথা। এর মধ্যে মানুষের সামাজিক মানসিকতা এবং ব্যক্তিমনের বহু সূক্ষ্ম ও জটিল অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটে থাকে। একদিকে সামাজিক শ্রেণীসম্পর্ক এবং অন্যদিকে অবচেতন মনের বিচিত্র প্রত্যাশা ও তাদের অপূর্ণতার বোধ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে ধৃত হয়ে এই ধরনের কাহিনীগুলির পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে। রাজা-রাণী-রাজপুত্র-রাজকন্যা-রাক্ষস-দৈত্য-ডাইনী-যাদু- মন্ত্র-অলৌকিকতা ইত্যাদির বহিঃসৌধের অন্তরালে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রত্যাশা ও নৈরাশ্য, আকাঙ্ক্ষা ও চরিতার্থতা এবং কল্পনা ও বাস্তবের পরিবেষ্টনীর উপাদান এদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।

রূপকথার নায়ক [কখনো নায়িকা] সচরাচর এক বা একাধিক দুরূহ কাজ সম্পন্ন করে সাফল্য লাভ করে। কখনো সে জাদুশক্তিসম্পন্ন কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সহায়তা পায়; কখনো তার প্রতিপক্ষ [রাক্ষস বা অনুরূপ কিছু অতিলৌকিক কোনো ক্ষমতা দেখায়, যদিও পরিণামে পরাভূত হয়। রূপকথার একটি অলিখিত বিধি হল এই যে, যারা অত্যাচারী এবং অন্যায়কারী, প্রবল হয়ে যারা দুর্বলের ক্ষতিসাধন করে কাহিনীর পরিণতি পর্বে তারা শাস্তি পাবেই; আর বঞ্চিত, লাঞ্ছিত এবং প্রতারিত হয় যে বা যারা – পরিণামে তাদেরই জোটে বিজয় এবং সাফল্য। নায়ক / নায়িকা এবং ভিলেন/ভ্যাম্প—এইভাবে যদি রূপকথার অন্তর্গত দুটি পরস্পর প্রতিস্পর্ধী চরিত্রকে গণ্য করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে রূপকথার অনামা-স্রষ্টাদের সহানুভূতির সবটাই পায় প্রথমোক্তরা। যেখানে 'খল’ চরিত্ররূপে আসে রাক্ষস বা দৈত্য [বিদেশী রূপকথায় কখনো বা ড্রাগন], সেখানে ঐ সহানুভূতি পায় রাজকন্যা- রাজপুত্র। যেখানে কোনো রাজ বা আর কোনো উচ্চ সামাজিক পদমর্যাদার মানুষ ভিলেনের ভূমিকায়, সেখানে রাখাল ছেলে বা কাঠকুডুনির মেয়ে জাতীয় সাধারণ ঘরের কেউ হয় নায়ক নায়িকা, অর্থাৎ, রূপকথার স্রষ্টারা [ যাঁরা নিজেরাও মূলতই ঐ সাধারণ ঘরেরই মানুষ] সর্বদাই নিজেদের অবচেতন প্রবণতার সূত্রে সমীকৃত হয়েছেন উৎপীড়ক-প্রতারকদের প্রতিস্পর্ধী চরিত্রের সঙ্গেই। ভিলেন যখন প্রত্যক্ষত রাক্ষস বা দৈত্য, তখন তার প্রতিস্পর্ধী যদি রাজা বা রাজপুত্রও হয়, সে আসলে দরিদ্র লোককথকেরই মানস-প্রতিভূ। সেখানে ভিলেন সরাসরিই রাজা বা বিত্ত- ঋদ্ধিমান্ কেউ, সেখানে লোককথকও সরাসরিই তাঁর স্ব- শ্রেণীর প্রতিনিধিস্থানীয় কারোকে রাখাল ছেলে কিংবা কাঠকুড়ুনি মেয়েকে মুখ্য চরিত্র রূপে দেখান। রূপকথকরা প্রকৃতপক্ষে গল্পের নায়ক / নায়িকাদের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করেই তোলেন না, বরং তারই অনুষঙ্গে জনজীবনের সামূহিক নিজ্ঞান মনে 'কালেকটিভ আনকনসাস্' বলেছেন যাকে [সি. জি. ] একটা ঐতিহ্যগত সংস্কারও গড়ে তোলেন। অতএব দুষ্টমতি সুখকে তার অজগর বর গিলে খায়, দুঃখিনী দুখু হয় রাজার বউ। স্নো হোয়াইটের সৎ-মা তার ওপর হিংসের নীল হয়ে মরে যায়, আর তার সঙ্গে হয় রাজপুত্তুরের বিয়ে। সিণ্ডারেলাকেই বিয়ে করে রাজকুমার, আর তার অত্যাচারী সৎ-বোনেরা উপহাসের পাত্রী হয়। শয়তান নেকড়ের পেট ফাটিয়ে শিকারী বার করে নিয়ে আসে লিটল রেড রাইডিংহুড আর তার দিদিমাকে। পেশাদার পত্নীঘাতী ব্লু-বেয়ার্ড তার সর্বশেষ স্ত্রীর ভাইদের হাতে নিহত হয়। কাজলরেখাকে দাসী বানিয়েও শেষ ইস্তক কাকনদাসীই হেঁটোয়-কাঁটা ওপরে- কাঁটার শাস্তি পেয়ে মরতে বাধ্য হয়, আর কাজল ফিরে পায় নিজের ঘরবর। শঙ্খকুমারের খড়গে পাষণ্ড সন্ন্যাসীর মুণ্ডুচ্ছেদ হয়। হ্যানসেন আর গ্রেটেলের বুদ্ধিতে ডাইনীবুড়ি পুড়ে মরে। অভাগিনী দুয়োরাণীর চম্পা পারুল ছেলেমেয়েরাই গল্পের শেষে রাজার আদর ফিরে পায়। সিংহাসনের অধিকার বর্তায় বুন্ধু-বাঁদর আর ভুতুমপেঁচার ওপরই।

রাক্ষস-খোক্কস-দৈত্য-দানা-ডাইনী-পেত্নী জনমানসের সামুহিক অবচেতন মনে এরা হল অশুভের প্রতীকবাহী রাজপুত্র-মন্ত্রীপুত্র-কোটালপুত্র-রাণী-রাজকুমারী আপাত- বিচারে সাধারণ মানুষের ওপরতলার বাসিন্দা হলেও, এদের মতো করে বেঁচে থাকার আকাঙ্খায় রূপকথার স্রষ্টারা এদের মধ্যে নিজেদেরকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন; অর্থাৎ যে শ্রেণীর হাতে বাস্তবে তাঁরা পীড়িত হন, তাদেরই প্রতিরূপ। যৌথ অবচেতনার এ এক বিচিত্র জটিল গ্রন্থি। তাই রূপকথার রাজপুত্তুরদেরও কঠিন শ্রম করে অভীষ্ট লাভ করতে হয়। [ যে ধরনের শ্রম নিচের সিঁড়ির লোককথকরা নিজেরাই করতে বাধ্য হন]; রাজারাণীও সর্বদা সুখে থাকেন না। আবার যেখানে সাধারণ ঘরের ছেলে বা মেয়েরা রূপকথার নায়ক / নায়িকা হয়, সেখানেও তাদের শ্রেণীগত ঊর্ধ্বায়ন ঘটে রাজার জামাই কিংবা রাজকুমারের বউ হওয়ার সূত্রে। নিজেদেরকে রূপকথার মধ্যে প্রতিফলিত করার এও একটি অবচেতন প্রবণতা।

বাস্তবে যে লড়াই করে যে বিজয়লাভ করতে চান তাঁরা, তারই আস্বাদ তাঁরা চান রূপকথার মধ্যে। রাজার অনেক টাকা, টুনটুনি পাখি তার থেকেই একটা তুলে নিয়ে নানাভাবে লাঞ্ছিত হল। কিন্তু পরিণামে রাজারই নাক কাটা গেল। এই রূপকধর্মী কথাই হল রূপকথা; আঞ্চলিক উচ্চারণে, 'উপকথা'। ইংরেজি 'ফেয়ারী টেল', জার্মান মার্শেন, রুশীয় 'স্কাজঈ' এবং ফিনীয় 'সাগেন' হল এরই সমধর্মী। তবে বাংলা রূপকথার সঙ্গে এদের একটি মৌলিক পার্থক্য আছে : রূপকথার সমতুল্য ঐ সব ইউরোপীয় প্রকরণগুলিতে রাজা-রাণী-রাজপুত্র-রাজকন্যারা যে জীবন- যাপন করেন, তা হল কায়িক শ্রমবিহীন স্বাচ্ছন্দ্য বিলাসের। পক্ষান্তরে, বাংলার রূপকথায় রাণীরাও বহু সময়েই কাপড় কাচেন, বাসন মাজেন, বাটনা বাটেন, কুট্‌নো কোটেন। প্রাচীনতর কৌম [ট্রাইবাল] সমাজের বাস্তবধর্মী অভ্যাসের স্মৃতি অবশেষ হিসেবেই এ জিনিসকে গণ্য করতে হয়। পক্ষান্তরে, ফেয়ারী টেল, মার্শেন প্রভৃতি গড়েই উঠেছে শ্রেণী বিভাজিত পরবর্তীকালের সমাজ-প্রেক্ষিতে। এই কারণেই বাংলা রূপকথাকে এদের চেয়ে প্রাচীনতর বলেই ধার্য করা চলে নিশ্চিতভাবে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন