শীতলা পূজার ইতিহাস সম্পর্কে জানুন

শীতলা পূজার ভৌগলিক বিস্তার:

২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলী জেলার দক্ষিণাংশে দেবী শীতলার বিশেষ প্রাদুর্ভাব। কিন্তু কেবল বাঙলাদেশ নয়-সারা ভারতেই শীতলার ব্যাপক প্রচলন আছে। বাঙলাদেশে শীতলার আকৃতি-প্রকৃতি ইত্যাদি বিচার করে এঁকে আর্যদেবী হিসাবেই গ্রহণ করতে হয়। আদি অবস্থায় ইনি উন্মুক্ত বৃক্ষতলে শিলাখণ্ডেই পূজা পেতেন, অনেক পরে দুর্গা বা জগধাত্রীর প্রতিরূপে এঁর মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে।

দেবীর পূজার ইতিহাস


গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উগ্র ও প্রাণ নাশক চর্ম রোগের থেকে রক্ষাকারিণী দেবী হিসাবে এঁর আরাধনার সূত্রপাত। দক্ষিণবঙ্গে শীতলাবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার যে প্রাচীন পদ্ধতিটি সংগ্রহ করা গেছে তা এরূপ: কোন ব্রাহ্মণ কন্যার আঘাতে মৃত্যু হলে তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করার পর নির্বাপিত চিতায় জল ঢালা হলে, শ্মশানযাত্রীরা পরিত্যাগকালে ভুলক্রমে কখনও কখনও সেই জলঢালার কলসীটি অভগ্ন অবস্থায় রেখে চলে আসে একশ্রেণীর ব্রাহ্মণ বা ওঝা সেই আংশিক জলপূর্ণ মৃৎকলসীটি গভীর রাত্রে নিয়ে আসে এবং বিগ্রহ প্রতিষ্ঠাকামী ব্যক্তিকে দান বা বিক্রয় করে। বস্ত্রালঙ্কারে সজ্জিত করে সেই কলসীটিকে অতি পবিত্র জ্ঞানে স্থাপন করে তাতে 'প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে শীতলা বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। কলসীর উপরিভাগে শিষযুক্ত ডাব, মুখমণ্ডল ইত্যাদিও স্থাপন করা হয়। বাংলার গ্রামাঞ্চলে শীতলার বিভিন্ন প্রকারের যে গঠনগুলি দেখা যাচ্ছে, তা হল : 

ক. হস্তপদ বিশিষ্ট মৃৎ বা দারু মূর্তি।
খ. বস্ত্রালঙ্কার সজ্জিত কলসী।
গ. প্রস্তরে খোদিত দেবীর অবয়ব।
ঘ. পিতল বা ধাতব বা লক্ষ্য নির্মিত মূর্তি।

প্রয়াত ব্যোমকেশ মুস্তফী বলেছেন, 'শীতলা পণ্ডিতদিগের শীতলাকর চরণহীনা, সিন্দুর লিপ্তাঙ্গী, শঙ্খ বা ধাতু খচিতা ব্রণ-চিহ্নাঙ্কিতা মুখমণ্ডল মাত্র বাশিষ্টা' [সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা: ৫ম বর্ষ ১ম সংখ্যা : পৃ. ২৭-৭০]। আমাদের মনে হয়, ব্রণ বা বসন্ত চিহ্ন খচিত প্রস্তরখণ্ডই দেবী শীতলার আদিমতম রূপ। পরবর্তীকালে তার রূপান্তর হয়েছে। শীতলার উদ্ভবের প্রথমকালে দেবীর সামনে পশু বলি দেওয়া হত।

মা শীতলার বিভিন্ন নাম

দেবী শীতলার যে সমস্ত নাম এ-পর্যন্ত সংগ্রহ করা গেছে সেগুলি এরূপ : কালমুছি, গ্রামবুড়ী, কাঁঠালবুড়ী, জঙ্গলবুড়ী, চড়ামবুড়ী, জাতাল, জাহীর বুড়ী, ঝাড়বাঘিনী, ডাকুইবুড়ী, গেড়ীবুড়ী, তেঁতুলবুড়ী, বুড়োমা, বুড়িঠাকুরাণী, বেনেবুড়ী, শেঁকড়াবুড়ী, হরিরাবুড়ী, হাউড়ি মা, খালবুড়ী, ঈশানমা, পুণ্যাবুড়ী, কুদ্রাবুড়ী, কালসুন্দী, কুমোর মা, কামার মা প্রমুখ।

শীতলা মায়ের উপাসক

শীতলা পণ্ডিতেরাই শীতলার পূজক হিসেবে পরিচিত হলেও উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণরাও আজকাল শীতলার পূজা করে থাকেন। শিব হলেন শীতলার পালক পিতা, রক্তাবর্তী শীতলার পার্শ্বচরী বা দাসী, ভারাসুর শীতলার আজ্ঞাবহ ভূতা, ঘণ্টাকর্ণ ছিলেন একজন মুনি ইনি শীতলার স্বামীরূপে বর্ণিতা। শীতলার সঙ্গে পূজিতা হন আরেক দেবী, অপদেবী বলেই যাকে বলা হয়ে থাকে, তিনি 'যোগিনী' বা 'যুগিনী'। শীতলা খানের নিকটবর্তী একটি বট অশ্বত্থ বা শ্যাওড়া বৃক্ষতলে এর থান কল্পনা করা হয়। এর নৈবেদ্যরূপে নিবেদিত হয় ভাঙাকুলো, মুড়ি, ধুচুনি, খই ইত্যাদি। এ-প্রসঙ্গে ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক বলেছেন, ‘Each Sitala worship is followed by the worship of Yuguni.' তবে ইদানিংকালে শীতলার নিয়ে একটি গানের বাৎসরিক পূজার সময়ই মাত্র যোগিনী পূজা হয়।

মা শীতলার বোন কারা?

দেবী শীতলারা সাত বোন। এরা হলো 'কাদা বসন্ত', ‘লোহা গড়িয়া’, ‘বেঁউচ্যা', 'চালতা কুলিয়া', 'মিলামিলা', “ওলাউঠা'। কিন্তু আমার মনে হয়, আঞ্চলিক ভাবে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও চৌষট্টি প্রকার বসন্ত রোগকেই এক একটি শীতলাশক্তি হিসাবে দেখতে গিয়ে এই সব দেবীর কল্পনা করা হয়েছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন