পরিভাষা কী? পরিভাষার অর্থ, তাৎপর্য ও রীতি



পরিভাষা (Technical Terms) :

কোনো বস্তু বিষয় কিংবা ভাবের পরিচয় বা যথাযথ অর্থবোধক শব্দ বা প্রতিশব্দকে বলে পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ। ভারতে আধুনিক শিক্ষার সূচনা ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিকিৎসা প্রভৃতি জ্ঞানের জগতে আধুনিকতায় ইউরোপীয় রেনেসাঁর সাথে উনিশ শতকের ভারতীয় নব জাগরণের আশ্চর্য মিল রয়েছে। যদিও প্রাচীন ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা-দর্শন-গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস গর্বের বিষয় এবং তা একান্তই ভারতীয়। ‘গণিতে শূন্য সংখ্যাটিও ভারতীয় অবদান'। তবুও ১৯ শতকেই অগ্রগতির ধারায় আন্তর্জাতিকতার ছাপ অস্বীকার্য নয় এবং সেজন্য ইউরোপের নিকটে আমাদের ঋণ অপরিসীম।

বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিদ্যা, দর্শন, মনোবিদ্যা, গণিত, সাহিত্যতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে এমন কিছু শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়, যাদের আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থে সীমায়িত করা যায় না। সেগুলি একটা বিশেষ অর্থ বহন করে, এরূপ বিশেষ অর্থবোধক শব্দগুলো হচ্ছে পরিভাষা। এক কথায় বিশেষ অর্থ পরিপোষক, বিশিষ্ট ভাষা। উল্লেখ্য, পরিভাষার ব্যুৎপত্তিগত বা প্রায়োগিক অর্থ ভিন্ন রূপ হতে পারে। কিন্তু তাকে পারিভাষিক শব্দ রূপে গ্রহণ করলেই সেটি বিশিষ্ট এক অর্থবোধক শব্দ হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা পায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, মননের আবিষ্কারে নব নব বিষয়গুলো জনসাধারণের কাছে পরিচিত ও প্রচারের জন্যে নির্দিষ্ট একটা সংজ্ঞা প্রয়োজন, যাতে সর্ব জাতির মানুষের সর্বজনীন অধিকার থাকে। কারণ জ্ঞানের কোনো ভৌগোলিক গণ্ডী থাকতে পারে না। তাই নতুনকে বিশেষ নামে চালাতে হয়, অন্যথায় বিভ্রান্তির সম্ভাবনা। সেই নতুন বস্তুর নামকরণ করে একটা সার্বিক ভাবনা-চিন্তা প্রসূত পরিভাষা সৃষ্টি হয়।

আমাদের দেশে ইংরেজী ভাষার বিস্তারের প্রভাবে (বাস্তবতা উপলব্ধি করে) প্রথম ইংরেজ মনীষী শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যক্ষ জন স্যাক শ্রদ্ধাশীল হন দেশীয় ভাষা- সংস্কৃতির প্রতি। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘Principle of Chemistry'-র গৌড়ীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন এবং বাংলা ভাষায় রসায়ন আলোচনা করেন ও পরিভাষা রচনার নির্দেশ দেন। সম্ভবত এটাই বাংলা পরিভাষা রচনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। এরপর ১৮৭৭-এ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের রচনা 'A Scheme for Rendering European Scientific Terms into the Vernacular of India' ভারতবাসীর পক্ষে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘদিন ব্যাপী 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা'য় পরিভাষা সংকলন প্রকাশিত হতে থাকে। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে'র কর্ণধারেরা ১৩১৩ বঙ্গাব্দে ভাষাবিজ্ঞান সমিতি, পরিভাষা সমিতি ও শব্দ সমিতি গঠন করেন। পরিভাষা গঠনের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে সংঘবদ্ধ চেষ্টা চালানো হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় 'কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সমিতি গঠিত হয়। সমিতির ন'জন সদস্যের অন্যতম ছিলেন ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সমিতি দশ বছরে (১৯৩৫-৪৪) গণিত, পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, শারীরবৃত্ত, প্রাণীবিদ্যা, মনোবিদ্যা, অর্থবিদ্যা ও ভূবিদ্যার পরিভাষা সম্বলিত দশখানি পুস্তিকা প্রণয়ন করেন।

স্বাধীনতা লাভের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষ উদ্যোগে 'পরিভাষা সংসদ' গঠিত হয়। এই সংসদ ১৯৪৮-এ সরকারী কার্যে ব্যবহৃত পরিভাষা প্রথম স্তবক' প্রকাশ করেন। বাঙালী মনীষীরা অনেকে পরিভাষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। এঁদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। অনেক পরীক্ষা- নিরীক্ষা, মতানৈক্য, মতবিরোধ নিয়ে পরিভাষার ভাবনা চলতেই থাকে। ১৯৭০-এ বাংলাদেশের 'বাংলা একাডেমী', 'পরিভাষা কোষ প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, সর্বত্রই এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত ভাষাকে। এছাড়া মোটামুটি স্বীকৃত হয়েছে প্রচলিত বাংলা শব্দকে উপযুক্ত কারণ ব্যতীত বর্জন করা যাবে না। আর পরিভাষা হবে সংক্ষিপ্ত, উচ্চারণ জটিলতা থাকবে না, উচ্চারণ সৌন্দর্যেও নজর দিতে হবে। যদিও এ সমস্ত ভাবনার সামঞ্জস্য সাধনে কিছু শব্দের সামান্য পরিবর্তনও ঘটেছে। সাংবাদিকরাও পত্রিকার প্রয়োজনে অনেক অর্থবোধক পরিভাষা চালু করেছেন। এ ব্যাপারে 'সরকারী বাংলা উপসমিতি' ১৯৮৫-র ৯ই আগস্ট বৈজ্ঞানিক ও তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশনামা প্রচার করে। বলা হয়—ক) পরিভাষা যথাযথ, সহজবোধ্য, সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। খ) প্রতিষ্ঠিত শব্দ বিদেশী হলেও যথাযথ কারণ ব্যতীত বর্জন করা হবে না। গ) পারিভাষিক শব্দ যেন বাংলা ভাষার স্বভাবের বিরোধী না হয়। ঘ) পরিভাষা সংক্রান্ত পূর্ববর্তী উদ্যোগকে মর্যাদা দেওয়া। ৫) প্রশাসন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ উপযুক্ত ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ। চ) হিন্দী ও অন্য প্রাদেশিক ভারতীয় ভাষায় নির্মিত পরিভাষাও প্রয়োজনে' বিবেচনা ইত্যাদি।

এখন প্রশ্ন, পরিভাষা ঠিক কী? অভিধান সূত্রে পরিভাষা শব্দের অর্থ—সংক্ষেপ অর্থের শব্দ। সহজ কথায় সুনির্দিষ্ট, সংশয়মুক্ত, সংক্ষিপ্ত, অর্থবোধক শব্দই হল পরিভাষা। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার বলেছেন—'পরিভাষা মানেই হচ্ছে শব্দের সর্বজন স্বীকৃত বিশিষ্টার্থ প্রয়োগ। পরিভাষা হবে ভাষার স্বকীয় প্রকৃতির অনুগত। সর্বজনগ্রাহ্য এবং যতটুকু সম্ভব আড়ষ্টতাহীন স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষ শব্দের বিশেষ অর্থবাচক হয়ে ওঠা পরিভাষার লক্ষ্য'। স্পষ্টই এতে চারটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়—সর্বজন স্বীকৃতি, স্বাভাবিকতা, বিশিষ্টার্থক প্রয়োগ ও আড়ষ্টহীনতা। আধুনিক কালে বলা হয়—পরিভাষা কোনো জ্ঞান ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক ধারণার নাম। এজন্য চাই সমন্বয় ও সম্মতি। কিন্তু আমাদের দেশে জ্ঞানী-গুণীদের সর্বতোভাবে চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলা বানানের মতোই পরিভাষাও সর্বজনসম্মত হয়নি নানা কারণে। প্রধান কারণ বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণে অনীহা, একটা নৈরাজ্য এবং অস্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি ইত্যাদি। পরিভাষা নির্মাণের বিভিন্ন উপায় ও রীতি বা পদ্ধতি রয়েছে। পরিভাষা হবে চিন্তার সংকেত, চিন্তার বাহন। সংক্ষিপ্ত শব্দ সুনির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত ও প্রয়োগে সংশয় মুক্ত। পরিভাষা গঠনের উপায় হল – পূর্বের শব্দ বা শব্দাংশ জুড়ে বা শব্দের অর্থ বদলে কিংবা অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে অথবা নতুন শব্দ নির্মাণ করে। আর এজন্য বিশেষ কয়েকটি দিকে দৃষ্টি দিতে হয়—

ক) পরিভাষার শব্দ ব্যাকরণসম্মত ও শুদ্ধ হতে হবে।

খ) নানা শাখাতে একটা বিদেশী শব্দের পারিভাষিক অর্থ যেন এক হয়।

গ) প্রাচীন শব্দের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে নব মূল্যায়ন করতে হবে।

ঘ) অনেক সময় তৎসম শব্দে পরিভাষা নির্মিত হয়। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে তাতে যেন (দীর্ঘ বা জটিলতা) সৌন্দর্য-মাধুর্য নষ্ট না হয়।

ঙ) পারিভাষিক শব্দ যেন বিদেশী ভাষার অনুবাদে একাধিক অর্থগ্রহণ না করে।

চ) নির্বাচিত শব্দের বহুমুখী মাত্রা যেন ঠিক থাকে।

ছ) শব্দের মূল উচ্চারণের দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।

জ) অতি উৎসাহ, অতি পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে হাস্যকর পরিস্থিতি যেন না হয়।

ঝ) পরিভাষা হবে সহজ, সরল, সর্বজনগ্রাহ্য মূল শব্দের অর্থানুগ কোনো শব্দ।

বর্তমানে বাংলা ভাষার গুরুত্ব খুব বেড়েছে। উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও স্বীকৃত ও প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছুদিন আগে এক সার্বিক পরিভাষা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন বাংলা ভাষায়। অন্যান্য বিষয়েও নানা পরিভাষা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য-বিজ্ঞান-কলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষায় পরিভাষা আবশ্যিক পাঠ্য হয়েছে। আমরা বর্তমান ক্ষেত্রে সাহিত্য ও ভাষা-কেন্দ্রিক কিছু পরিভাষার তালিকা তুলে ধরতে পারি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন