শৈলীবিজ্ঞান কী? শৈলীবিজ্ঞানের ধারা সম্পর্কে আলোচনা
শৈলীবিজ্ঞান :
ল্যাটিন শব্দ ‘স্টিলোস’-এর অর্থ মোমের চৌকো টুকরোতে লেখার ছুঁচলো কলম। এই স্টিলোস থেকে 'স্টাইল' শব্দের উৎপত্তি। ইংরেজি স্টাইলের অর্থ ‘রীতি’ বা “শৈলী”। বর্তমানে ‘রীতি’ অপেক্ষা 'শৈলী'র আবেদন বেশি। বস্তুত 'শৈলী' লেখকের সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। তাঁর চিন্তন, মনন, অনুভবের যে নিজস্ব রীতি—তার প্রকাশই হল শৈলী।
শৈলীবিজ্ঞান হল শৈলী সম্পর্কে বিধিবদ্ধ আলোচনা। ভাষার উপকরণে মিশে থাকে ব্যক্তিগত প্রবণতা, বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতি, সাহিত্যিক প্রেরণা—ভাষা ব্যবহারকারী একটা নিজস্ব ধারা স্থাপন করে, যার মাধ্যমে লেখকের নিজস্ব সত্তাটি ধরা পড়ে। তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। এই যে লেখক-কবির নিজস্ব প্রকাশ রীতি, তাই হল শৈলী। আর এ সংক্রান্ত আলোচনা শৈলীবিজ্ঞান বা Stylistics।
ভারতীয় সাহিত্যে বামনাচার্য অনেক কাল পূর্বেই রীতিবাদের আলোচনায় বিশিষ্ট পদরচনা রীতি'র কথা বলেন। এই শব্দ বা পদ বিন্যাসের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিই রীতির মূল। রীতি সূত্রেই বাক্য কাব্য হয়। ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য' বিশ্বনাথ রীতিকে দেখেছেন কাব্যের বিশিষ্ট অবয়ব সংস্থানে বিষয় হিসেবে। রীতয় অবয়ব-সংস্থান বিশেষবৎ”। তবে উল্লেখ্য সংস্কৃত 'রীতি' আর ইংরেজী ‘Style’ এক নয়। ভারতীয় রীতিবাদ বহিরঙ্গ রচনা পদ্ধতি। Style-এ স্রষ্টার ব্যক্তি ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আসলে শৈলী হল বিশেষ এক নির্মাণ, যা ব্যক্তিসাপেক্ষ, রচয়িতার নিজস্ব; 'Style is the man himself", পাশ্চাত্যে ভাষাবিজ্ঞান ও সাহিত্য সমালোচনা দুটি ধারায় শৈলীবিজ্ঞান চর্চার 'আধুনিক ভাবনা'র সূচনা বিশ শতকে। ক্রমশ তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইংলণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে। কিন্তু আমাদের দেশে শৈলীবিজ্ঞানের আলোচনা তেমন ভাবে হয়নি। এ বিষয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নানা চিন্তা' গ্রন্থের (১৩২০ বঙ্গাব্দ) ‘উপসর্গের অর্থবিচার' প্রবন্ধে প্রথম শৈলীবিজ্ঞান চর্চার সূচনা। পরে রবীন্দ্রনাথ 'শব্দতত্ত্ব' (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থে শব্দদ্বৈত, ধন্যাত্মক শব্দ ইত্যাদি আলোচনায় শৈলীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এরপর উল্লেখযোগ্য, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বাংলা গদ্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন শিশিরকুমার দাশ ‘Early Bengali Prose' (1966) গ্রন্থে। নবেন্দু সেন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে 'গদ্য শিল্পী অক্ষয়কুমার ও দেবেন্দ্রঠাকুর' গ্রন্থে বিভিন্ন ভাষার তুলনা, শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদি আলোচনা করেন। পরবর্তী কালে শৈলী ভাবনায় অগ্রগতির বিরাম নেই। বর্তমানে স্পষ্ট যে, শৈলী মূলত ব্যক্তিগত বিষয়। রবীন্দ্রনাথ 'সাহিত্যের সামগ্রী' প্রবন্ধে
যথার্থ বলেছেন, ‘রচনা বলিতে গেলে ভাবের সহিত ভাব প্রকাশের উপায় দুই সম্মিলিত ভাবে বুঝায়, কিন্তু বিশেষ করিয়া উপায়টাই লেখকের। অবশ্য আধুনিক শৈলী বিজ্ঞানে শব্দের রূপগত, ধ্বনিগত, অর্থগত দিকেই বিচার্য। যথাযথ শব্দ নির্বাচন করে আকো, প্রেরণা, উৎসাহ, সংবাদ জ্ঞাপন, জ্ঞানবৃদ্ধি, সৌজন্য বিনিময় প্রভৃতির যথাযথ কৌশল ও ব্যবহার সাহিত্য স্রষ্টাকে করতে হয়। সেগুলোই সেই লেখকের শৈলী ও প্যাটার্ন। যার সূত্র ধরে কাব্যে ও সাহিত্যে কবি ও লেখকের নিজস্ব শৈলী নির্মিত হয়। তা ছন্দে, শব্দে, পদ ব্যবহারে, অলংকার প্রয়োগে, বাক্য প্রণয়নে নির্মিত হয়। বস্তুত লেখকের স্বেচ্ছা নির্বাচিত বা অসচেতন ভাবে ব্যবহৃত ভাষাগত উপায় গ্রহণ করেন। কেউবা বাক্যে কর্তা বা ক্রিয়ার স্থান বদল করে নিজস্ব শৈলী নির্মাণের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠেন, গড়ে তোলেন নিজস্ব একটা গঠন প্রক্রিয়া। তাই স্বতন্ত্র মানুষের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মতোই সাহিত্য নির্মাতার ব্যক্তিত্বেও ভাষা ও সাহিত্য শৈলী নির্মিত হয়। যুগ ভেদেও শৈলী বদলায়। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে শৈলী পরিবর্তিত হয়ে যায়। একই সাহিত্য নির্মাতাও কালের ব্যবধানে পাল্টে ফেলেন নিজস্ব শৈলী। বৈচিত্র্যও দেখা যায় বিষয়ের ভিত্তিতে—যেমন সাহিত্য, আইন, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে শৈলীর পরিবর্তন দেখা যায়। আবার শিক্ষামূলক রচনার ক্ষেত্রে পাঠকের অবস্থান ভেদে শৈলীর বৈচিত্র্য বিষয় গভীরতা নির্ভর করে। ভাষা কিংবা সমালোচনা সাহিত্য সর্বত্রই বক্তব্য বিষয়ের মান ও পাঠকের বিবেচক ক্ষমতার উপর রচনার শৈলী নির্ধারিত হয়।
শৈলীবিজ্ঞানের ধারা :
শৈলীবিজ্ঞান নানাভাবে আলোচিত হলেও মনে রাখতে হবে শৈলীবিজ্ঞান হল। সাহিত্যের শৈলী বিষয়ের আলোচনা। যা নিছক বিশ্লেষণের বিষয় নয়, এর একটা নন্দনতাত্ত্বিক দিক রয়েছে। শৈলীর বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এর জন্ম। ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রে সাহিত্যের শৈলীকে যাচাই করার প্রবণতা থেকেই শৈলীবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। ভাষাচর্চার ফলেই শৈলীচর্চার অগ্রগতি। সাহিত্য ভাষার সাহায্যে যে শিল্প সৌকর্য লাভ করে, সেই সৌন্দর্যের বিচারকে বুঝতে সাহায্য করে শৈলীবিজ্ঞান।
শৈলীবিজ্ঞানের আলোচনার শুরুতে ভাষাবিজ্ঞানীরা থাকলেও ক্রমশ এর সমালোচনা ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ফরাসি পণ্ডিতেরা। অন্যান্যদের তুলনায় তাঁদের আলোচনার গভীরতাও বেশি। শুরুতে বাকপ্রতিমা, রূপক, প্রতীক প্রভৃতি শৈলী বিজ্ঞানের সাহিত্যকেন্দ্রিক বিষয়। চমস্কির 'সংবর্তনী সঞ্জননী ব্যাকরণতত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকে শৈলীবিজ্ঞান ভাষাগত দিক থেকে গুরুত্ব পেতে থাকে। প্রাধান্য লাভ করে, দুটি বিষয়-সংবর্তনী সঞ্জননী ব্যাকরণতত্ত্ব এবং বাকা ও শব্দের অর্থ। এই ভিত্তিতে শৈলীবিজ্ঞানের তিনটি প্রধান শাখা। ১. শৈলী ভাষাবিজ্ঞান, ২. সাহিত্য শৈলীবিজ্ঞান এবং ৩. সাধারণ শৈলীবিজ্ঞান। প্রথমটি ভাষা বিজ্ঞানের, দ্বিতীয়টি সাহিত্য আলোচনা এবং তৃতীয়টি উভয় শাখার মিলিত রূপ।
শৈলীবিজ্ঞানে শাখা সূত্রে দেখা যায়—শৈলীবিজ্ঞানে নির্দিষ্ট নিয়ম বা নিয়মের বাতিক্রমের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ব্যাকরণ, শব্দ নির্মিতি, বাক্যনির্মিতি, বাক্যবিন্যাস, বিচ্যুতি, অলংকারতত্ত্ব, পরিসংখ্যান প্রভৃতি। এগুলোর ভিত্তিতেই নির্মিত হয় কাব্য-সাহিত্যের শৈলী। গদ্য-পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই যে বিশ্লেষণ তা হল শৈলীবিজ্ঞানের প্রণালী তত্ত্ব। ব্যাকরণের নিয়মনীতি সূত্রে ধ্বনি শব্দবিন্যাসে বাক্য গঠন, কাব্যযোজনা, রচনার শুরু ও শেষ—এই উপকরণ সহ, বিশেষ সামাজিক অবস্থা ও সাহিত্যিক প্রেরণা এবং বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামগ্রিক প্রকাশভঙ্গীর সঙ্গতি প্রয়োজন। আর এর মধ্যে ধ্বনি ব্যবহার, শব্দের বৈচিত্র্য ও সুপ্রয়োগ ঘটিয়ে শব্দের মালা গেঁথে নির্মিত হয় বাক্য। বাংলা বাক্যের ক্ষেত্রে কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া সজ্জার বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে শৈলী বৈচিত্র্য। গদ্য শৈলীর ক্ষেত্রে উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, লিখিত ভাষণ, চিঠি, প্রবন্ধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদসজ্জায় বাক্যের শৈলী নির্ধারণ করা যায়। আর তা ব্যক্তি ও কাল বিশেষে স্পষ্ট হয়। সেগুলোর বিশ্লেষণই শৈলীবিজ্ঞানের উপজীব্য। যার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণে অনুশীলন সাপেক্ষ একটা শৃঙ্খলায় পরিণত হয়। রচনা ও সৃষ্টির মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়।