বাংলা গদ্যের উদ্ভবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা
বাংলা গদ্যের উদ্ভবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা
ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বে বাংলা গদ্যের বিকাশে যে সব প্রতিষ্টান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তাদের মধ্যে প্রধান। প্রশাসনিক কাজে সাফল্য ও গতি বাড়াতে ওয়েলেসলি নবাগত সিভিলিয়ানদের আঞ্চলিক ভাষায় কিছুটা শিক্ষিত করে কাজে নিয়োগ করতে মনস্ত করেন। সেই জন্যই ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্টা করা হয়। এই কলেজের বাংলা, মারাঠি ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়ে উইলিয়ম ফোর্ট বুঝেছিলেন গদ্য ভাষায় রচিত পাঠ্য বই না হলে ভাষা শিক্ষাদান সম্ভব নয়। সেজন্য প্রথম থেকেই তিনি পাঠ্যবই রচনার দিকে মনোযোগ দেশ।
কলেজের কাজ আরম্ভের প্রথম বছরেই রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র' প্রকাশিত হয়। এইটি বাংলা অক্ষরে ছাপা প্রথম মৌলিক বাংলা গদ্যগ্রন্থ । কেরি সাহেব ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যবই রচনার জন্য রামরাম বসুকে তার পূর্ব পুরুষ রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে একটা জীবনী ও ইতিবৃত্ত লিখতে বলেন। রামরাম বসু নানা ফার্সি উপাদান থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করে এই গ্রন্থটি রচনা করেন।
রামরাম বসু ছাড়াও যে সমস্ত পন্ডিতদের দিয়ে কেরি মাহের গদ্যগ্রন্থ লিখিয়েছেন, সেগুলি হল
১. গোলকনাথ শর্মার 'হিতোপদেশ'
২. রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের 'মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং'
৩. চন্ডীচরণ মুনশীর 'তোতা ইতিহাস'
৪. কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের 'পদার্থ তত্ত্ব কৌমুদী'
এছাড়াও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামকিশোর তর্কচূড়ামনি, তারিণীচরণ মিত্র, মোহনপ্রসাদ ঠাকুর, হরপ্রসাদ রায় এবং স্বয়ং কেরি সাহেব।
এই গোষ্ঠীর সব থেকে শক্তিশালী লেখক ছিলেন মৃত্যুয় বিদ্যালঙ্কার। তিনি শুধু পন্ডিত মানুষ ছিলেন না, সাহিত্যবোধ তার যথেষ্ট ছিল। এককথায় বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবের পূর্বে তিনি ছিলেন সত্যিকারের ভাষাশিল্পী। রামমোহনের যুগে রামমোহনের প্রতিবাদ করেও তিনি কোন কোন বিষয়ে উদার ও যুক্তিপূর্ণ পন্থার অবলম্বন করেছিলেন। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - 'বত্রিশ সিংহাসন', 'রাজাবলী', 'প্রবোধচন্দ্রিকা', 'হিতোপদেশ'। 'বত্রিশ সিংহাসন' ও 'হিতোপদেশ' সংস্কৃত কাহিনীর সরল অথচ গম্ভীর রুপান্তর। রাজাবলী বাঙালীর রচিত প্রথম ইতিহাস। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস বলেছেন -
"সংশয় নেই, অন্তত গদ্য রচনার ক্ষেত্রে মৃত্যুঞ্জয় কেবল ভাষাবিদ ছিলেন না, ছিলেন স্বার্থক ভাষাশিল্পীও।”
প্রয়োজনের তাগিদে কেরি সাহেবও দুটি গ্রন্থ রচনা করেন । বাংলা ভাষা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেছিলেন। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। সেজন্য গ্রাম বাংলার মানুষের কথাবার্তাকে অনুসরন করে লেখেন 'কথোপকথন”। এতে মুখের কথা বা জীবত ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ফেরি সাহেব অনেক রুচীহীন শব্দ ব্যাবহার করেছেন। তাই কথোপকথনের ভাষা অমার্জিত ও অনুসরনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তার পরের গ্রন্থ 'ইতিহাস মালা' তে ভাষা অনেক উন্নত এবং মার্জিত।
যাই হোক দেখা যাচ্ছে যে বাংলা গদ্যের সূচনা ও বিকাশের লগ্নে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান যথেষ্টই ছিল । কলেজের যে সমস্ত পণ্ডিতেরা বাংলা গদ্যের চর্চা করেছেন এবং বাংলা গদ্যকে একা সম্মানের আসনে দাড় করিয়েছেন, তাঁদের প্রশংসা না করে পারা যায় না ।