বাংলা কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তের কৃতিত্ব




বাংলা কবিতার পালাবদলে ঈশ্বর গুপ্তের কৃতিত্ব


⇒ উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা সংস্কৃতি ও কাব্য কবিতায় কবি ঈশ্বর গুপ্ত বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তিনি একাধিক সাময়িক পত্র পরিচালনার সূত্রে সংবাদপত্রের চাহিদা মতো বহু কবিতা লিখেছেন। তাই তার কবি প্রতিভার স্বভাবই ছিল সাংবাদিক ধরনের। সংবাদিকতাই তার কবিতার শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক।


ঈশ্বর গুপ্তকে পুরানো ধারার শেষ লেখক এবং নতুন ধারার প্রথম লেখক বলা যায়। কবিতাতে যদিতে তার পুরাতন ধারার প্রতি আনুগত্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু স্বাদেশিকতায় তিনি ছিলেন নতুন ধারার অগ্রদুত। মঙ্গলকাব্যের প্রাচীন ধারাটিকে বর্জন করলেও ভারতচন্দ্র ও কবিওয়ালাদের স্থূল রসিকতা তার মধ্যে দেখা যায়। তবে অন্যদিকে স্বাদেশিক মনোভাব ও রঙ্গব্যঙ্গের তীক্ষ্ণধার সৃষ্টি ও নতুন পুরাতনের প্রভাব স্বীকার করে নেওয়া তার কবি প্রতিভা ও মানসিক প্রবনতার একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য।


ঈশ্বর গুপ্ত অল্প বয়সে পদ্যরচনায় হাত দিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কবিগানের দলের জন্য গান রচনা করে দিতেন। তার অধিকাংশ কবিতা সংবাদ প্রভাকর ও অন্যান্য সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাগুলিকে মোটামুটি ৫ টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়-

১. ধর্ম ও নীতিশিক্ষা বিষয়ক

২. সমাজ বিষয়ক

৩. সমসাময়িক ঘটনা বিষয়ক

৪. প্রেম বিষয়ক

৫. ঋতু বিষয়ক

৬. গীতি কবিতা বিষয়ক


ঈশ্বর গুপ্ত মূলত কবি। বহু কবিতা তিনি লিখেছেন, তবে সেসব কবিতা গীতিকবিতা পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। গীতিকবিতার যেটা প্রধানধর্ম, হৃদয়ের গভীর কোন অনুভূতির শিল্পসম্মত প্রকাশ, তা তাঁর কবিতায় নেই। কোন ব্যঞ্জনা বা নিহিত তাৎপর্য নেই। তবুও ভাষা, ছন্দ, অনুপ্রাস এবং উপস্থাপনের অভিনবত্বের জন্য কবিতাগুলি পাঠকের মনোহরণ করেছে।


ইশ্বর গুপ্তের সামাজিক চেতনা ছিল ব্যাপক, কিন্তু তার সামাজিক অনুভূতি ছিল অগভীর। জীবনের প্রত্যেকটি সমস্যাকে তিনি যথাযথ ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন, যথার্থ সাংবাদিকের মতো তার স্বরূপ বিচার করেছেন। কিছু শিল্পীর মতো জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি। কবি ঈশ্বরগুপ্ত সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্তকে অতিক্রম করতে পারেননি বলেই তার কবিকর্ম অগভীর ও অসম্পূর্ণ।


উনিশ শতকের মাঝামাঝি কয়েকটি স্বদেশ প্রেমের কবিতা রচিত হয়েছিল। ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতারা তার স্বদেশে প্রেমের কবিতা পড়েই অনুপ্রেরণা লাভ করতো। জননী ভারতভূমিকে তার আগে কেউ এভাবে ডাকেননি - 


"জননী ভারতভূমি
আর কেন থাক তুমি
ধর্মরূপ ভুষাহীন হয়ে।"


স্বদেশ ও মাতৃভাষায় ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা কাব্য কবিতার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম অভিনন্দিত করেন।


ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে আছেন, শুধুমাত্র উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য নয়। ওতে তার প্রতিভা যথার্থ মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন সমকালীন সমাজ জীবনকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে লেখা হাস্য পরিহাস ও কৌতুকের কবিতা- গুলির মধ্য দিয়ে। এর মধ্যে তাঁর সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, বাস্তবচিত্র অঙ্কনের অভিজ্ঞতা, অসঙ্গতির প্রতি কটাক্ষপাত, মেয়েদের উগ্র বিবিয়ানা-এসব ব্যাপার তার লেখনীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।


ঈশ্বর গুপ্ত করুণ স্নিগ্ধ রসের কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আবেগের পরম শত্রু। জীবনের নানা অসঙ্গতির প্রতি অম্লমধুর ব্যঙ্গের বান নিক্ষেপে তিনি ছিলেন সব্যসাচীর মতো অব্যর্থ লক্ষ্য। ভাবাবেগে আদ্র বাংলা সাহিত্যে তিনি বুদ্ধির চমক এনেছেন। এলায়িত প্রেম ও প্রণয়ের জায়গায় সামাজিক জীবনের হাস্যরসকর চিত্র অঙ্কন করেছেন। এজন্য তিনি বাংলা কাব্যে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন । বঙ্কিমচন্দ্র তাই যথার্থই বলেছেন -


"যাহা আছে, ঈশ্বর গুপ্ত তাহার কবি । তিনি এই বাংলা সমাজের কবি। তিনি বাংলা গ্রাম্যদেশের কবি। ঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং Satirist."


মনে রাখা দরকার ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন উদীয়মান নব্যবঙ্গের একদা বলিষ্ঠতম সাংবাদিক। কেবল সংবাদপত্রের স্তম্ভে নয়, সরস্বতীর কাব্যকুঞ্জেও সেই নবযুগ সংক্রমনের সংবাদ পৌছে দিয়ে গেছেন। তিনি ছন্দবদ্ধ ভাষায় আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রস্তুতি পর্বে এক স্বার্থক কবি সাংবাদিক।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ