বঙ্কিমচন্দ্রকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় কী?
=> বঙ্কিমচন্দ্রের তিরোধানের পর এক স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রকে সব্যসাচী আখ্যা দিয়েছিলেন। রসস্রষ্টা ও বিচারক রূপে বঙ্কিমের সিদ্ধি উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথের সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি লাভ করেছিল। চন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন-
"অভ্যাগতদিগের অভ্যর্থনা করিতেছি এমন সময়ে একটা বিদ্যুৎ সভাগৃহে প্রবেশ করিল।"
এই বিদ্যুৎ বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী বঙ্কিমচন্দ্র। উনবিংশ শতাব্দীর এক বিশেষ লগ্নে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব। বঙ্কিম প্রতিভা ও পাশ্চাত্য ভাবধারাকে সাঙ্গীকৃত করেছিল বলেই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর খ্যাতি স্রষ্টা ও সম্পাদক হিসেবে।
সেকেলে সমস্ত সাহিত্যযশ প্রার্থীদের মতোই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে হাতে খড়ি হয়েছিল ইশ্বরগুপ্তের পাঠশালায়। তার সাহিত্যের প্রচেষ্টার প্রথম স্বাক্ষর হচ্ছে 'ললিতা' আর মানস কাব্যগ্রন্থ। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ তার 'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসে। উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য জগতে বিরাট একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল । একবছর পরে 'কপালকুন্ডলা', তারপর প্রকাশিত হলো মৃনালিনী। বঙ্কিমচন্দ্রের মৌলিক প্রতিভা বাংলা সাহিত্যে চিরকালের জন্যে স্থিরকৃত হয়ে গেল।
১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হল বঙ্গদর্শন। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের নেতৃত্ব গ্রহন করলেন, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে গুলি একটি লেখক গোষ্ঠী। তারপর থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের একটির পর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হতে লাগল। সে উপন্যাসগুলির নাম- বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, চন্দ্রশেখর, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, দৈবী চৌধুরানী, 'কৃষ্ণকান্তের উইল' ইত্যাদি। কেবল উপন্যাসেই নয় প্রবন্ধ রচনাতেও বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষতা ছিল অনতিক্রমনীয়। কী বৈজ্ঞানিক, কী সামাজিক, কী ধর্মমূলক সবদিক থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র ছিল অতুলনীয়। তার লোকরহস্য, 'বিজ্ঞান-রহস্য, 'সাম্য', 'কৃষ্ণচরিত্র', 'ধর্মতত্ত্ব', 'সেই উৎকৃষ্ট প্রতিভার নিদর্শন। 'কমলাকান্তের দপ্তর' বঙ্কিমচন্দ্রের আরেকটি অসাধারণ রচনা। বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলা সাহিত্যের পথিকৃত বলা হয়। বাংলা উপন্যাস বলতে আমরা যা বুঝি তার গঠন, তার প্রকৃতিকে রূপ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এইটুকুই বঙ্কিম প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় নয়। তিনি শুধু সার্থক উপন্যাস রচনা করেননি, সত্যিকার উপন্যাস বলতে কী বোঝায়, তার আদর্শ কী হওয়া উচিত, সেটাও আমাদের কাছে স্থাপন করে গেছেন । একদিকে তিনি সুষ্ঠ উপন্যাস রচনা করেছেন সেই সঙ্গে রচনা করেছেন বলিষ্ঠ প্রবন্ধ। আরেকদিকে বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যারা ছেলেখেলা করত, তাদেরকে তিনি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -
"সব্যসাচী বঙ্কিমচন্দ্র এক হস্ত গঠন কার্যে, এক হস্ত নিবারণ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন । রচনা এবং সমালোচনা এই উভয়কার্যের ভার বঙ্কিম একাকি বহন করাতে বঙ্গ-সাহিত্য এত সত্ত্বর এমন দ্রুত পরিনতি লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিল।”
প্রাচীন ভারতীয় জীবনধারাতে আস্থাবান, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্রের গভীর আলেখ্য হচ্ছে তার উপন্যাস। কিন্তু তাই বলে, তার সাহিত্য প্রচার কার্যে পরিণত হয়নি। কাহিনি পরিবেশনে, ঘটনার সংঘাতে, চরিত্র সৃষ্টিতে সেগুলির মধ্যে আদর্শ উপন্যাসে সমস্ত গুনগুলি বর্তমান রয়েছে। মানুষের স্খলনকে তিনি কোনদিন ক্ষমার চোখে দেখতে পারেননি। নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে, নানা সংঘাতের মধ্যে মানুষকে তিনি দেখেছেন মহিমাময় মুর্তিতে। মোহিতলালের মতে-
“তিনি মানবপ্রীতি ও চরিত্রনীতি এই দুয়েরই অসম্পূর্ণতা ঘুচিয়াইয়া যতকিছু ব্যর্থতা আর সংকীর্ণতা সত্ত্বেও মানুষের মহিমাকে আধুনিক যুগধর্মের অনুরূপ করিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।”
বঙ্কিমচন্দ্র তাই সাহিত্য জগতের সম্রাট। বাংলা সাহিত্য আজ তাই তারই গৌরবে গরবিনী।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন