বারাসত অঞ্চলের কবি বিপ্রদাস পিপিলাই-এর লেখা মনসামঙ্গল (বা মনসাবিজয়) বাংলার সর্বপ্রাচীন মনসামঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে অন্যতম। এই কাব্যে কবি এইভাবে কাব্য রচনার কাল নির্দেশ করেছেন,
সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শাহা গৌড়ের প্রধান ।।
সুতরাং ১৪১৭ শকাব্দ বা ১৪৯৫-৯৬ খ্রীষ্টাব্দই বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলকাব্যের রচনাকাল। কিন্তু এই তারিখে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সন্দেহের প্রধান কারণ, কাব্যের নবম পালায় চাঁদো অর্থাৎ চাঁদসদাগরের বাণিজ্যযাত্রার বর্ণনায় ক'টি স্থানের উল্লেখ। এক জায়গায় রয়েছে,
খড়দহে শ্রীপাটে করিয়া দণ্ডবত।
বাহ বাহ বলিয়া রাজা ডাকে অবিরত।
আর এক জায়গায় আছে,
পূৰ্ব্ব কূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা।
বেতড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা ॥
১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দের পরে নিত্যানন্দ খড়দহে বসতি স্থাপন করলে খড়দহ ভক্তদের কাছে শ্রীপার্ট নামে পরিচিত হয়। আর 'কলিকাতা' জব চার্নকের আগমনের (১৬৯০ খ্রীঃ) পরে খ্যাতি অর্জন করে।
এ ছাড়াও নবম ও দশম পালায় চাঁদোর বাণিজ্যযাত্রার বর্ণনায় হুগলী, ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, পাইকপাড়া, ভদ্রেশ্বর, চাপদানি, ইছাপুর, রিসিড়া (রিসড়া), সুখচর, কোন্নগর, কোতরং, কামারহাটি, দিগঙ্গা (দেগঙ্গা), ঘুসুড়ি, চিতপুর, বারুইপুর প্রভৃতি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐ সব স্থানের অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলে প্রাধান্য অর্জন করে; প্রাচীন সাহিত্যের অন্য কোথাও এই স্থানগুলির উল্লেখ দেখা যায় না। নবম পালায় “নিমাই-তীথ” নামে একটি স্থানের উল্লেখ দেখা যায়, নিঃসন্দেহে চৈতন্যদেবের “নিমাই” নামটিই এই তীর্থের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই সব কারণে এই মনসামঙ্গলের প্রাচীনত্বে সন্দেহ প্রকাশ করা অযৌক্তিক নয়।সন্দেহের কারণ আরও আছে। এই কাব্যের চতুর্থ পালায় (হাসন-হোসেন পালা) হাসনের অন্তঃপুরের বর্ণনা দেবার সময়ে বলা হয়েছে গোলামেরা হাসনের সেবা করার সময়ে
কেহ আনন্দিত হৈয়া সুবর্ণের হুকা লৈয়া
তমাকু ভীরয়া দেয় আগে।
কিন্তু “তমাকু” বা তামাক ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা ভারতবর্ষে প্রথম এনেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর কোন কবির রচনায় এর উল্লেখ থাকা অসম্ভব। তামাক তখনও আমেরিকার বাইরে যায় নি।
তারপর, এই কাব্যের এক জায়গায় লেখা আছে (এসিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সংস্করণ, পৃঃ ১৪৩) যে সপ্তগ্রামে
নিবসে যবন জত তাহা বা বলিব কত
মোঙ্গল পাঠান মোকাদীম।
"মোঙ্গল পাঠান” অর্থাৎ কিনা মোগল-পাঠান। কিন্তু মোঙ্গলরা মুসলমান নয়। আসলে যাঁদের 'মোগল' (শব্দটি 'মোঙ্গল' শব্দেরই বিকৃত রূপ) বলা হয় (বরাবর ভুল করেই বলা হয়ে এসেছে), তাঁরা আসলে তুর্কী জাতির চাগতাই শাখার লোক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে—'মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা বাবরের ভারতবর্ষে আসার কয়েক দশক আগে—সপ্তগ্রামে চাগতাই তুর্কী মুসলমানরা বাস করতেন কিনা, অথবা করলেও তাঁদের “মোঙ্গল” বলা হত কিনা, অথবা তখন “মোঙ্গল-পাঠান” এই জাতীয় উক্তি লোকে করত কিনা? এই তিনটি প্রশ্নেরই সম্ভাব্য উত্তর—না। অতএব, “মোঙ্গল-পাঠান-এর উল্লেখ থেকে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলকে অর্বাচীন রচনা বলে সন্দেহ করা যেতে পারে।
যা হোক, সন্দেহের কারণ খুব যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মনে হয়, বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল' ১৪১৭ শকাব্দেই রচিত হয়েছিল। কারণ,
(১) রচনাকালসূচক শ্লোকটিতে “গৌড়ের প্রধান” – “হুসেন শাহ্” অর্থাৎ আলাউদ্দীন হোসেন শাহের উল্লেখ আছে। যদি। ধরা যায় যে—বইটি ১৪১৭ শকাব্দে লেখা নয়, পরবর্তীকালে কোন লোক জাল করেছিল—তা' হলে প্রশ্ন উঠবে জালিয়াৎ কী করে জানতে পারল যে ১৪১৭ শকাব্দে হোসেন শাহ্ “গৌড়ের প্রধান ছিলেন ?
(২) বিপ্রদাসের “মনসামঙ্গল” নবম পালার মধ্যে লেখা আছে যে, বাণিজ্যযাত্রার সময়ে উজনি, কাটোয়া, নদীয়া, ফুলিয়া, হাতিকান্দা, গুপ্তিপাড়া, সিঙ্গারপুর, ত্রিবেণী প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করার পরে চাঁদো বললেন,
দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম।
তথা সপ্তঋষি স্থান সৰ্ব্বদের অধিষ্ঠান
সোক্ষ মোক্ষ রম্যতর ধাম ।।
এরপর কবি সমৃদ্ধ ও জনাকীর্ণ সপ্তগ্রাম নগরীর বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন (অবশ্য এই বর্ণনার মধ্যেও কিছু কিছু প্রক্ষিপ্ত উপাদান প্রবেশ করেছে)। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তগ্রাম কদরের অবনতি ঘটতে থাকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শহরটি ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং বিপ্রদাসের 'মনসামঙ্গল' ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের আগেই লেখা বলে মনে হয়—যে সময়ে সপ্তগ্রাম সমৃদ্ধ নগরী ছিল এবং লোকে গঙ্গার উপর দিয়ে যাবার সময় সপ্তগ্রাম ভাল করে না দেখে যেত না।
এর থেকে আমাদের মনে হয়, বিপ্রদাসের 'মনসামঙ্গল' মূলত ১৪১৭ শকাব্দ বা ১৪৯৫-১৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দেই রচিত হয়েছিল, পরে তাতে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ যুক্ত হয়েছে। আমাদের ধারণার সমর্থনে একটি প্রমাণ উদ্ধৃত করছি। কাব্যের প্রথম পালায় বিপ্রদাস লিখেছেন,
সংক্ষেপে পদ্মার ব্রত কহিল মঙ্গলগীত
বিস্তারে কহিব সপ্ত নিশি ৷৷
কিন্তু বর্তমানে (এসিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সংস্করণ দ্রষ্টব্য) কাব্যটিতে তেরটি পালা পাওয়া যায়। এর থেকে বোঝা যায়, কবি মূলে সাতটি পালায় কাব্যটিকে সম্পূর্ণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত উপাদান যুক্ত হয়ে কাব্যটি স্ফীতকায় হয়েছে এবং সাতটি পালাকে ভেঙে তেরটি পালায় দাঁড় করানো হয়েছে।
কেউ কেউ বলেছেন যে, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলের প্রচার আদৌ ছিল বলে জানা যায়। না—সুতরাং তাতে প্রক্ষেপ পড়বে বলে ভাবা চলে না। কিন্তু আমরা এই মত সমর্থন করতে পারি না। কারণ বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলের চারটি পুথি এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে, বিপ্রদাসের বাসভূমির নিকটবর্তী দত্তপুকুর, জাগুলিয়া, ছোট জাগুলিয়া প্রভৃতি গ্রামের লোকেরা এই পুথিগুলি নকল করেছিল এবং এই অঞ্চল থেকেই সব ক'টি পুথি সংগৃহীত হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, বাংলার অন্য কোন অঞ্চলে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলের প্রচার না হলেও, তাঁর নিজের দেশে তার যথেষ্টই প্রচার হয়েছিল। পুরুষানুক্রমে ঐ অঞ্চলের লোকেরা বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল গান করেছে এবং তাতে রাশি রাশি প্রক্ষিপ্ত উপাদান ঢুকিয়েছে। যেমন—নিরঞ্জন বা ধর্মঠাকুরের মহিমা বর্ণনা করে কয়েকটি পরিচ্ছেদ রচনা করে এই কাব্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এ-কাব্যের অষ্টমঙ্গলায় বলা হয়েছে নিরঞ্জনই মনসা ; কেন এবং কীভাবে তিনি মনসারূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে যা এখন মূল কাব্যে মেলে না, মনে হয়; মূল কাব্য থেকে ঐ কাহিনীটি তুলে দিয়ে তার স্থানে নিরঞ্জন-ধর্মঠাকুরের কাহিনী বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাব্যের প্রথম পালায় প্রদত্ত আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়—বিপ্রদাসের পিতার নাম মুকুন্দ ; তিনি সামবেদী ব্রাক্ষ্মণ—কৌথুম শাখা ('কুতুব শাখা' পাঠ ভ্রমাত্মক), বাৎস্য গোত্র, পঞ্চ প্রবর, তাঁর পদবী 'পিপলায় বা পিপিলাই। কবিরা চার ভাই। তাঁর বাসভূমি নাদুড্যা- বটগ্রাম। নাদুড্যা বা নাদুড়িয়া গ্রামের এখন সন্ধান মেলে না বলে, তার স্থানে বাদুড্যা (বাদুড়িয়া) পাঠ কল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু আমার বন্ধু স্বর্গত সুরেশচন্দ্র নিয়োগী ঊনবিংশ শতাব্দীর ডাক-বিভাগ ও রাজস্ব-বিভাগের নথিপত্রে নাদুড়িয়া ও বটগ্রাম নামে পাশাপাশি দুটি গ্রামের সন্ধান পেয়েছিলেন বলে আমায় জানিয়েছিলেন; দুটি গ্রামই এখন হাবড়া (উত্তর ২৪ পরগণা) শহরের মধ্যে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। অতএব বিপ্রদাস পিপিলাইকে হাবড়ার লোক বলা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম- সুখময় মুখোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন