১
গায়ে হলুদ হল বাংলাদেশের বিবাহের একটি প্রধান স্ত্রী আচার। এই অনুষ্ঠান বিহার, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র প্রমূখ ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও বিভিন্ন নামে প্রচলিত রয়েছে। বাংলার সর্বত্র অবশ্য এক দিনে বা এক নামে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় না। কোথাও গায়ে হলুদ কোথাও আইবুড়ো বা যুবোরা অনুষ্ঠানে কোথাও বর কনে স্নান নামে আবার কোথাও আশীর্বাদ বা অধিবাস নামের অনুষ্ঠানে এই আকারটি পালিত হয়। এর প্রধান উপাচার অবশ্যই তেল ও হলুদ। তবে কোথাও তার সঙ্গে মুগ বা গিলাবাটা কোথাও সুন্দা, মেথি বাটা থাকে। উত্তরবঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গে কোন কোন স্থানে বর কনে লাল পাড় শাড়ী পরে পিড়িতে দাঁড়ায়। নাপিত নখ কেটে দেয়। তারপর হলুদ ছোয়ানো হয় তাদের কপালে।
২
উত্তরবঙ্গে এয়োরা লাল পাড় পরে। মুখে পান, আস্ত গোটা সুপারি ও মিষ্টি রাখে। মাথাভাঙ্গা, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, রাজশাহীতে আইবুড়ো ভাতের দিন এই অনুষ্ঠান হয়। বগুড়ায় বিয়ের পূর্ব দিনে, কুমিল্লায় বিয়ের দিনে কনে ও বরকে সাজানোর পূর্বে পাঁচ সধবায় তেল হলুদ ঢালে। বরিশালে বিয়ের দিন বর কনেকে অখন্ড পিড়িতে বসিয়ে দু কোনায় পঞ্চ শস্য, কড়ি, দূর্বা, গিলা কাঁচা মুগ দিয়ে তিন বা পাঁচ জন সধবা বেটে মাখিয়ে দেন। আখের গুড় দিয়ে পিঠে মানুষ আঁকা হয়। বর কনে পেছনে অঞ্জলি পেতে রাখে। তাতে পাঁচ পো চাল সাত বার তাদের হাতে দিলে তার নিজের পাত্রে পড়ে। একটা তৈলপূর্ণ পাত্রে বর কনে মুখ দেখে ও পরে স্নান করে। ঢাকায় বিবাহ সজ্জার পূর্বে এই ভাবেই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়। পূর্ববঙ্গে বিয়ের পূর্ব দিনে হলুদ কোটা হয় এবং অধিবাস বা বিয়ের দিন এই হলুদ ব্যবহার হয়।
৩
পশ্চিমবঙ্গে গায়ে হলুদ নামটি প্রচলিত। এখানে তেল হলুদ বরের গায়ে দেবার পর তা কনের বাড়ি পাঠানো হয়। দূরে হলে বরযাত্রার সঙ্গে তা যায়। বাঁকুড়ায় পাঁচ/সাত/নয় জন সধবায় আই হাঁড়ি ভাড়ের গলদেশে ৭ থেকে ৯ বার সুতো দিয়ে বেড় দিয়ে পরে বর কনেকে তেল হলুদ মাখায়। রাঢ় অঞ্চলেও বিবাহের পূর্ব অথবা বিয়ের দিন এই অনুষ্ঠান হয়। মুসলমানদের মধ্যেও এই অনুষ্ঠান বিয়ের সাত, নয় বা এগারো দিন পূর্বে, কোথাও বিয়ের আগের দিন এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এই উপলক্ষে পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পাত্র পক্ষ হতে মেয়ের জন্য তেল হলুদের সঙ্গে রেশম, রূপটান, মাথা ঘষা যায়। তেমনিই যায় একটি ছোট কলসীপূর্ণ তেল, লাল পাড় শাড়ি, লাল গামছা, একটি জলচৌকি, মাদুর, দই, সন্দেশ ও মাছ। এটি গায়ে হলুদের তত্ত্ব। এর সঙ্গে পাত্র পক্ষের আর্থিক অবস্থা অনুসারে কনের জামা, শাড়ি, প্রসাধনের উপকরণ, দু-একটি অলংকার, পান-সুপারি, পান-মশলা, খয়ের, বড় এলাচ, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, জৈত্রি, ধনের চাল, মৌরি, তবক মোড়া পান ইত্যাদি কনের বাড়িতে তত্ত্ব হিসেবে পাঠানো হয়। সঙ্গে একটি চন্দন বাটি, আশীর্বাদে পিরিচে ধান, দূর্বা, ফুলমালা ও একটি কাজল লতার মধ্যে কলার মাঝপাতা লালসুতো দিয়ে বাঁধা পাঠানো হয়। এটি কনের হাতে থাকে।
৪
পূর্ববঙ্গে সাধারণত কোন তত্ত্ব যায় না। সেখানে অধিবাসের তত্ত্ব হিসাবে এরূপ তত্ত্ব দেওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে। পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গে এমনকি মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুদের অনুরূপ বরের ছোঁয়া তেল হলুদ নানা তত্ত্ব সহ কনের বাড়ি পাঠানো হয় এবং তা মাখানো হয়। বাঁকুড়ায় সাঁওতালদের মধ্যে গায়ে হলুদ দেয় মাঝিবুড়াই ও মাঝি হাড়াম। পরে বর কনের ডান হাতে কিছু আতপ চাল, গোটা হলুদ ও হলুদ বাটা আম পাতায় জড়িয়ে হলুদ ছোপানো সুতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। ওই চালের কলেবর বৃদ্ধি ভাবীপুত্র কন্যার সম্ভাবনা প্রকাশ করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন