চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনি | Story of Chandimangal Kavya

পর সকল মঙ্গলকাব্যে একটি কাহিনীই প্রধান, কিন্তু চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে প্রধান কাহিনী দুটি, এবং এই দুটি কাহিনীই পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শুধু তাই নয়, কাহিনী দুটির উৎপত্তিও ভিন্ন ভিন্ন কালে এবং উভয় কাব্যে চণ্ডীর কাহিনী বর্ণিত হলেও তাঁরা যে মূলত কিংবা কুলতঃ এক নন, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।


চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনীর তিনটি খণ্ড— প্রথম খণ্ড দেবখণ্ড। বিভিন্ন দেবতার বন্দনার পর সৃষ্টিতত্ত্ব-আদি বর্ণনা করেই কবি দক্ষযজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, পার্বতীরূপে পুনর্জন্মলাভ এবং মহাদেবকে স্বামীরূপে প্রাপ্তির কাহিনী পুরাণ অনুযায়ী রচনা করে গিয়েছেন। অতঃপর হরগৌরীর জীবনযাত্রা-বর্ণনাতেই কবি কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের অভাব-অনটনের ফলে যে দাম্পত্যকলহের সৃষ্টি হয়ে থাকে, তেমনি এক কলহের ফলেই দেবী বুঝলেন, নিজেকে সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে চিরদিন লাঞ্ছনা-গঞ্জনাই ভোগ করতে হবে। অতএব দেবী স্থির করলেন, মর্ত্যলোকে আপন পূজা প্রচার করতে হবে। মহাদেবের সহায়তায় দেবী ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপগ্রস্ত করে মর্ত্যলোকে পাঠালেন। এখানেই দেবখণ্ডের সমাপ্তি। কিন্তু নামে দেবখণ্ড হলেও চণ্ডীমঙ্গলের কবিরা সাধারণত বাস্তব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হরগৌরীর জীবনযাত্রার চিত্র অঙ্কন করেছেন। গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড, আখেটিক খণ্ড বা কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী। ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর ব্যাধসন্তান কালকেতুরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন । দেবী চণ্ডী এই ব্যাধকে সহায় করেই মর্ত্যলোকে পূজা প্রচার করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বনের পশুকুলের পূজা গ্রহণ করেছেন, তাদের অভয় দান করেছেন, স্বয়ং গোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন, কালকেতুকে মাণিক্যের অঙ্গুরী এবং সাত ঘড়া ধন পাইয়ে দিয়েছেন। ওদিকে আবার কলিঙ্গরাজ্যকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে চণ্ডীপূজা করতে বলেছেন।

কালকেতু ঐ ধনের সাহায্যে অরণ্য কেটে গুজরাট নগর পত্তন করেছে, কিন্তু প্রজা না আসায় চণ্ডী কলিঙ্গরাজ্যে ঝড়-বন্যার উপদ্রব সৃষ্টি করলে উৎপীড়িত প্রজাকুল নবসৃষ্ট গুজরাট রাজ্যে এসে আশ্রয় গ্রহণ করলো। অতঃপর কালকেতুর সঙ্গে কলিঙ্গ রাজের যুদ্ধ বাধল। সেই যুদ্ধে কালকেতু পরাজিত ও বন্দী হলো। অতঃপর চণ্ডীর স্তবস্তুতি পাঠ করলে চণ্ডীর কৃপায় কালকেতু মুক্তি লাভ করে স্বরাজ্যে ফিরে এলো। এই কালকেতুর কাহিনীতে কোন লৌকিক কাব্যের প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়। এখানে যে চণ্ডীর বর্ণনা করা হয়েছে, ইনিই ওঁরাও জাতির পূজিতা চণ্ডী, যিনি পশুকুলের অধিষ্ঠাত্রী এবং ব্যাধকুলের দ্বারা পূজিতা। লক্ষ্য করবার বিষয়, চণ্ডী পূজা লাভ করবার জন্য অতিশয় উৎসুক, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোন নীচতার পরিচয় নেই। কিছুটা ছলনার পরিচয় দিয়েছেন বটে, কিন্তু তা এত কৌতুকরস-মিশ্রিত যে দেবীর ছলনার কথা ভুলে যেতে হয়। সাধারণত দস্যুদের দ্বারা পূজিতা চণ্ডীর সম্বন্ধে সাধারণের মনে একটা ভীতির ভাব বর্তমান থাকলেও এই চণ্ডীর মধ্যে কোন হিংস্রতার পরিচয় পাওয়া যায় না।


গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড বণিকখণ্ড অথবা ধনপতি সদাগরের কাহিনী। বনের রাখালদের নিকট থেকে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা শিখে খুল্লনা স্বগৃহে তার প্রচলন করলে স্বামী ধনপতি তাঁর অপরা পত্নী লহনার প্ররোচনায় মঙ্গলচণ্ডীর ঘট ভেঙ্গে দেন। অতঃপর তিনি সিংহল যাত্রা করেন। দেবী এবার সুযোগ পেয়ে অপমানের প্রতিশোধ নিলেন। ধনপতি কালীদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখে সেই অলৌকিক কাহিনীর কথা সিংহলরাজকে জানালেন। কিন্তু সিংহলরাজকে এই দৃশ্য দেখাতে না পারায় ধনপতি কারারুদ্ধ হলেন। অতঃপর পিতা ধনপতির সন্ধানে এলো পুত্র শ্রীমন্ত সদাগর। সেও স্বয়ং কমলে-কামিনী মূর্তি দেখল, কিন্তু রাজাকে দেখাতে না পারায় কারারুদ্ধ হলো। অতঃপর মশানে নীত হ'য়ে শ্রীমস্ত চণ্ডীর স্তবস্তুতি পাঠ করে শুধু যে মুক্তি পেল, তা নয় পিতার সঙ্গে তার মিলন ঘটল এবং রাজকন্যাকেও বিবাহ করে পিতাকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরে এলো।


গ্রন্থের এই খণ্ডে যে চণ্ডীর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, এই চণ্ডীই প্রকৃত মঙ্গলচণ্ডী। এই চণ্ডীর পরিকল্পনায় অনেকেই বৌদ্ধ-প্রভাবের কথা বলে থাকেন। চণ্ডীমঙ্গলের সৃষ্টিতত্ত্বেও এই বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বুদ্ধ বা ধর্মকে বলা হয় আদিদেব, আর চণ্ডীকে বলা হয়েছে আদ্যাশক্তি। মানিক দত্ত-রচিত 'চণ্ডীমঙ্গলে'র সৃষ্টি-প্রকরণে বৌদ্ধ শূন্যবাদ এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতের প্রভাবের পরিচয় সুস্পষ্ট। শূন্যপুরাণের ভূমিকায় চারু বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টতই স্বীকার করেছেন যে বৌদ্ধ আদ্যা ক্রমশঃ হিন্দুর চণ্ডী হইয়া শিবের ভার্যা হইলেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন