দৌলত কাজী ও তাঁর কবিপ্রতিভার পরিচয়
রোসাঙ-রাজ থিরি-থু-ধম্মা বা 'বুদ্ধাচারী' রাজা শ্রীসুধর্মার 'লস্কর উজীর' আশরফ খানের আদেশে দৌলত কাজী তাঁর ‘সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রানী' নামক কাব্য রচনা করেন। শ্রীসুধর্মার রাজত্বকাল ১৬২২ খ্রীঃ-১৬৩৮ খ্রীঃ। অতএব কবি দৌলৎ কাজী এই কালেই বর্তমান ছিলেন অনুমান করা যায়। কবি গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা-প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে শ্রীসুধর্মার লস্কর উজীর পণ্ডিত প্রধান শ্রীযুক্ত আশরফ খানের সভায় নানা কাব্য পঠিত হতো । তথায় ঠেট হিন্দীতে সাধন-রচিত 'মৈনা-সৎ’কাহিনী শুনে আশরফ খান কবিকে দেশি ভাষায় তা আবার রচনা করতে অনুরোধ করলেন :
“ঠেঠা ছোপাইয়া দোহা কহিলা সাধনে।
না বুঝে গোহারী ভাষা কোন কোন জনে।।
দেশী ভাষে কহ তাকে পাঞ্চালীর ছন্দে।
সকলে শুনিয়া যেন বুঝয়ে সানন্দে।।
তবে কাজী দৌলতে সে বুঝিয়া আরতি।
পাঞ্চালীর ছন্দে কহে ময়নার ভারতী।।''
সেনাপতির আদেশে দৌলত কাজী সাধন কবি-রচিত হিন্দী ‘মৈনা সত' কাব্যের বাঙলা অনুবাদ রচনা করেন। সাধন-রচিত কাব্যের অতিক্ষুদ্র এক পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা থেকে মনে করা যায় যে দৌলত কাজী মূলের কোন কোন অংশ আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন, কোথাও কাহিনীমাত্র গ্রহণ করেছেন। 'সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রানী' কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত। কিন্তু কবির আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রন্থখানি খণ্ডিত অবস্থায় ছিল। তিনি দ্বিতীয় খণ্ডে সতী ময়নামতীর বারমাস্যার এগার মাসের কাহিনী বর্ণনার পরই দেহত্যাগ করেন। অতঃপর দ্বিতীয় খণ্ডের অবশিষ্ট অংশ এবং তৃতীয় খণ্ড রচনা করেন কবি আলাওল।
'বৈশাখ সমাপ্ত জ্যেষ্ঠ অসাঙ্গ রহিলা।
তবে কাজী দৌলত স্বর্গেতে হৈল লীন।'- আলাওল
লোরচন্দ্রানী:
লোররাজার ময়নামতী নামক এক সুন্দরী রাণী ছিলেন। রাণীর প্রতি রাজার আকর্ষণ কিছুটা কমে গেলে রাজা এক যোগীর নিকট গোহারী-রাজকন্যা অপূর্বসুন্দরী চন্দ্রানীর সন্ধান পেলেন। চন্দ্রানী ছিলেন বামনবীরের পত্নী। এই সংবাদ শুনে লোর রাজা গোহারী গমন করলেন এবং তথায় সুযোগ সৃষ্টি করে চন্দ্রানীর সঙ্গে মিলিত হলেন। অতঃপর পলায়ন করতে চেষ্টা করলে বামন তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। কিন্তু লোর রাজার হস্তে তিনি পরাজিত ও নিহত হলেন। এদিকে চন্দ্রানী অকস্মাৎ সর্পদংশনে প্রাণত্যাগ করলে এক ঋষি এসে তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। গোহারীর রাজাও সংবাদ পেয়ে এসে পরম সমাদরে লোর ও চন্দ্রানীকে আপন রাজ্যে নিয়ে গিয়ে তাদের বিবাহ দিলেন। এইস্থানে প্রথম খণ্ড সমাপ্ত। দ্বিতীয় খণ্ডে ময়নামতীর বিরহ বর্ণিত হয়েছে। তার অবস্থা দেখে প্রতিবেশী রাজার পুত্র ছাতন এক দূতীর সহায়তায় ময়নামতীকে হস্তগত করতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু ময়নামতী আপন সতীধর্মে দৃঢ় থেকে ছাতনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তৃতীয় খণ্ডে সতী ময়নামতী এক ব্রাহ্মণের হাত দিয়ে লোর রাজার নিকট এক শুকপক্ষী পাঠালেন । ব্রাহ্মণই কৌশলে লোররাজার মনে পূর্বস্মৃতি জাগিয়ে তুললে লোর চন্দ্রানী-সহ আপন রাজ্যে ময়নামতীর নিকট প্রত্যাবর্তন করলেন।
কাব্যবিচার:
অনেকের মতে দৌলত কাজী লৌকিক সাহিত্যের প্রথম কবি বলেই নয়, প্রাচীনতম এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি বলেই অভিহিত হবার যোগ্যতা রাখেন। ইসলাম ধর্ম ও সুফী সাধনা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। তিনি সম্ভবতঃ সুফী চিশতির সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। সূফীবাদের সঙ্গে কবির সম্পর্ক থাকায় তাঁর কাব্যে একটা উদার মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ প্রসঙ্গ তাঁর কাব্যের বহু স্থলেই বর্তমান। কবির পৃষ্ঠপোষক আসরাফ খানও ছিলেন চিস্তি খানদান। কালিদাস, জয়দেব এবং বিদ্যাপতির রচনার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ছিল প্রচুর, এমন কি হিন্দুর বেদ পুরাণেও যে তিনি কৃতবিদ্য ছিলেন, তাঁর কাব্যেই এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এই পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি প্রশংসার্হ হলেও মুসলমান কবিদের মধ্যেও তাঁর চেয়ে অধিকতর পণ্ডিতজনের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। দৌলত কাজীর কৃতিত্ব এই পাণ্ডিত্যের সঙ্গে কবিত্বশক্তির সংমিশ্রণে। ডঃ সুকুমার সেন বলেন : “দৌলত কাজীর কবিত্ব বিশেষ উপভোগ্য। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দাবী করিতে পারেন তাহাতে সন্দেহ নাই। কি বাঙলা কি ব্রজবুলি উভয়বিধ রচনাতেই তিনি সমান দক্ষতা দেখাইয়াছেন।” অপর একজন সমালোচক দৌলত কাজীর কাব্য বিশ্লেষণ-প্রসঙ্গে কবির কৃতিত্বের কথা নিম্নোক্ত ক্রমে প্রকাশ করেছেন : "দৌলত কাজীর রচনার এই স্বতো-বিকশিত সারল্য ও অনায়স-সরসতা তাঁর কাব্যকে লোকজীবনের সার্থক রোম্যান্টিক প্রণয়গাথার শিল্পমূল্য দান করেছে। লক্ষ্য করা উচিত্র কাব্য-কাহিনীর মধ্যে লোকজীবন-সম্ভব সামাজিক প্রণয়-সৌন্দর্য শ্রেষ্ঠাসন-লাভে সমর্থ হয়নি। 'লোরচন্দ্রানীর'র যৌথ প্রণয় মাধুর্যের চেয়েও সতী ময়নামতী একা উজ্জ্বলতর বর্ণে চিত্রিত হয়েছেন দৌলতের কাব্যে। দৌলত কাজীর বিশ্বাসী কবি-কল্পনা রোমান্টিক প্রণয়সৌন্দর্যকে ত্যাগ-তিতিক্ষাপূর্ণ বেদনার রঙে অনুরঞ্জিত করেছে ; যৌবন-প্রেম সাধনার মহিমা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।” আলাওল 'লোর চন্দ্রানী'র যে অংশ রচনা করেছিলেন কাব্যধর্মে তা দৌলত কাজী-রচিত অংশ অপেক্ষা হীন। দৌলত কাজী যদিও অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তৎসত্ত্বেও তাঁর মৌলিক প্রতিভাকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ, কাজী বহুস্থলেই সাধন-রচিত কাব্যের বহির্ভূত অনেক অংশ স্বয়ং রচনা করেছেন। এই মৌলিক রচনা অংশে কবি-প্রতিভার উৎকর্ষ অনুভূত হয়।