সৈয়দ আলাওল ও তাঁর কবিপ্রতিভা | কাব্য কাহিনী ও কাব্য বিচার
কবি পরিচিতি:
রোসাঙ রাজসভায় যে সকল কবি বর্তমান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অদ্ভুত জনপ্রিয়তায় আলাওল (জন্ম আ. ১৬০৮ খ্রীঃ) ছিলেন শ্রেষ্ঠ। আলাওল তাঁর কাব্যে বিস্তৃতভাবে আত্মপরিচয় দান করেছেন। মুল্লুক ফতেহাবাদের অন্তর্ভুক্ত জালালপুর গ্রামে কবি জন্মগ্রহণ করেন। স্থানটি ফরিদপুর জেলায় হওয়া সম্ভব, আলাওলের পিতা ছিলেন মজলিস কুতুবের অমাত্য। পিতাপুত্র স্থানান্তর যাবার কালে জলদস্যুর হস্তে পড়েন এবং আলাওলের পিতা মৃত্যুবরণ করেন। আলাওল কোনক্রমে রোসঙে উপস্থিত হলেও সভার সদস্য হবার সুযোগ পেলেন না, তিনি অশ্বারোহী সৈন্যদলে ভর্তি হলেন। কিন্তু অত্যল্পকাল মধ্যেই আলাওলের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি রটে গেলে তিনি রোসাঙরাজ 'সাদউ মেংদার' বা থদো মিস্তার মুখ্য অমাত্য মহাজন মাগন ঠাকুরের সৌহার্দ্য লাভ করলেন। কবির পৃষ্ঠপোষক মাগন ঠাকুরের অনুরোধে কবি 'পদ্মাবতী কাব্য' রচনা করেন। থদো মিস্তার রাজত্বকাল ১৬৪৬ খ্রী:- ১৬৫২ খ্রীঃ। অতএব এরই মধ্যবর্তী কোন সময়ে কবি আলাওল রোসাঙ রাজদরবারে আশ্রয়লাভ করেছিলেন বলে অনুমিত হয়। অতঃপর আলাওল তাঁর দ্বিতীয় কাব্য সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল' রচনা আরম্ভ করেন। ইতোমধ্যে কবির আশ্রয়দাতা মাগন ঠাকুর পরলোকগমন করেন। তখন রোসাঙের রাজা ছিলেন থিরি সান্দ থুধম্মা বা শ্রীচন্দ্র সুধর্মা । বাদশাহ শাজাহানের পুত্র শাহ সুজা এই সময় (১৬৬১ খ্রীঃ) ঔরংজীবের ভয়ে রোসাঙ রাজসভায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। কবির সঙ্গে শাহ সুজার সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। শাহ সুজা রাজকোপে পড়ে বিড়ম্বিত হলে অপরের প্ররোচনায় কবি আলাওলও কিছুদিনের জন্য বন্দীজীবন যাপন করেন। যা হোক, মুক্তিলাভ করবার পরও তিনি কিছুদিন নানাপ্রকার দুর্ভোগ ভোগ করে অবশেষে রোসাঙের কাজি সৈয়দ মাসুদের অনুগ্রহ লাভ সুফী সম্প্রদায়ের করে কাদেরী মতে দীক্ষিত হলেন। সৈয়দ মাসুদের নির্দেশেই তিনি অসমাপ্ত সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জমাল' কাব্য সম্পূর্ণ করেন। আলাওলের পাণ্ডিত্যের কথা শুনে রোসাঙ-রাজ শ্রীচন্দ্র সুধর্মার (সম্ভবত ১৬৭২ খ্রীঃ-র পর) প্রধান অমাত্য মজলিস বিরাজ তাঁকে 'সেকেন্দারনামা' অনুবাদ করতে আদেশ করলেন।
'আরবী ফারসী পোস্ত নছরানী ইহুদী।
পহলবি সঙ্গে পঞ্চ ভাষ রত্নাবধি ।।'
নেজামী রচিত 'দারা সেকেন্দারনামা' গ্রন্থে এই পঞ্চভাষার ব্যবহার আছে — আলাওল পিতৃতুল্য 'অন্নদাতা ভয়ত্রাতা' রাজার আদেশে উক্ত গ্রন্থের ফারসী 'বয়েত' ভেঙ্গে পয়ার ছন্দে গ্রন্থ রচনা করলেন সম্ভবত ১৬৭৪ খ্রীঃ বা সমসময়ে। আলাগুলের অপর রূপকথা জাতীয় কাব্য 'সপ্ত পয়কর' বা 'হপ্ত পয়কর' শ্রীচন্দ্র সুধর্মার সেনাপতি সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে রচিত (১৬৬০-৬১ খ্রীঃ) হয়। মূল গ্রন্থটি নেজামী কর্তৃক ফারসী ভাষায় রচিত হয়েছিল। আলাওলের আর একটি গ্রন্থ 'তরফা' বা 'তোহফা'। য়ুসুফ গদা-কর্তৃক ফারসী ভাষায় রচিত গ্রন্থ-অবলম্বনে আলাওলের এই গ্রন্থ রচিত হয়। ১০৭৩ হিজরী বা ১৬৬৩-৬৪ খ্রীঃ গ্রন্থ সমাপ্তিকাল বলে কবি স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। রোসাঙ- রাজের মহাপাত্র সুলেমান এই গ্রন্থটি রচনার জন্য আদেশ করেছিলেন। এছাড়া আলাওল যে দৌলত কাজীর রচনা ‘লোর চন্দ্রানী' (১৬৫৯ খ্রীঃ) গ্রন্থ সমাপ্ত করেছেন, তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আলাওল বলেছেন যে তিনি বহু গ্রন্থই রচনা করেছেন। পূর্বে যে সকল গ্রন্থের কথা বলা হয়েছে, তা ছাড়াও তাঁর পক্ষে আরও বহু গ্রন্থই রচনা করা সম্ভব—অনেকেই এরূপ অনুমান করে থাকেন। মুন্সী আব্দুল গফুর সিদ্দিকী আলাওল-রচিত 'য়ুসুফ জোলায়খা, লায়লা মজনু, শিরিখোসরো-নামা এবং আজিজকুমার-রসবতী' কাব্যের সন্ধান পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর বাস্তব ভিত্তি নেই। বস্তুত সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগে কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী ব্যতীত অপর কোন কবিই বোধহয় এত অধিক গ্রন্থ রচনা করেন নি। এ সকল ব্যতীতও আলাওল অনেকগুলি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থ “রাগনামা'।
আলাওলের জন্মকাল এবং গ্রন্থ রচনাকাল সম্বন্ধে সমালোচকগণ একমত হতে পারেন নি। ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেবের মতে কবির জন্মকাল ১৫৯২ খ্রীঃ এবং তিনি যথাক্রমে পদ্মাবর্তী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জমাল, সতী ময়নামতীর উত্তরাংশ, হপ্তপয়কর, তোহফা ও সেকেন্দার- নামা' রচনা করেন। কিন্তু ডঃ সুকুমার সেন এবং অন্যান্য সুধী ঐতিহাসিকদের অনেকেই এই কালক্রম-বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন।
কাব্যবিচার:
কবির শ্রেষ্ঠ রচনা হল 'পদ্মাবতী'। মালেক মহম্মদ জায়সীর হিন্দী ভাষায় রচিত 'পদুমাবতী' নামক কাব্যের অনুবাদ-রূপে গ্রন্থটি রচিত হয়েছে বলে সাধারণত বলা হলেও একে অনুবাদ কাব্য বলা সঙ্গত নয়। আসলে এতদুভয়ের মধ্যে কাহিনীগত কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও কাব্যাদর্শে, রূপ-কল্পনায় এবং কোন কোন কাহিনীতেও বৈসাদৃশ্যের পরিমাণ বড় কম নয়। জ্ঞানী সাধক মালেক মুহম্মদ জায়সী তাত্ত্বিক আদর্শের দিকে লক্ষ্য রেখেই 'পদ্মাবতী' রূপক-কাব্য রূপে রচনা করেছিলেন।
তিনি নিজেই বলেছেন যে তাঁর কাব্যোক্ত চিতোর রাজ্য মানবমন, রাজা রত্নসেন জীবাত্মা, রাণী পদ্মাবতী বিবেক এবং শুরুপক্ষী ধর্মগুরু। পক্ষান্তরে আলাওলের কাব্যে এই আধ্যাত্মিক ভাবনার একান্ত অভাব। তিনি প্রেম-কাব্যরূপেই গ্রন্থটি রচনা করেছেন। কাহিনীর দিক থেকেও উভয়ের পার্থক্য লক্ষ্য করবার মত। মূল গ্রন্থটি বিয়োগান্তক এবং তাতে সম্রাট আলাউদ্দিনকে বিজয়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আলাওলের গ্রন্থ অনেকটা মিলনান্তক এবং এতে আলাউদ্দিন পরাজয় বরণ করেছেন। রসের দিক থেকে বিচার করলেও দেখা যাবে যে আলাওল কাব্যটিকে অনেকটা বৈষ্ণব কাব্যের রসে সিজ করেছেন। এগুলি ছাড়া কাব্যের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়েই উভয় কাব্যের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। জায়সীর কাব্যে নেই, তেমন বহুতর বিষয়ও আলাওল আপন কাব্যে সন্নিবিষ্ট করেছেন। এই সমস্ত কারণেই আলাওলের কাব্যকে অনুবাদ গ্রন্থ না বলে স্বাধীন মৌলিক গ্রন্থ বলে গ্রহণ করাই সঙ্গত। 'পদ্মাবতী' গ্রন্থের কাহিনীটি দুই অংশে বিভক্ত।
প্রথম অংশে চিতোররাজ রত্নসেনের সিংহল-রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিবাহ ও চিতোর প্রত্যাবর্তন-কাহিনী, দ্বিতীয় অংশে সম্রাট আলাউদ্দিন-কর্তৃক পদ্মাবতী-লাভ প্রত্যাশায় চিতোর আক্রমণ, যুদ্ধ, আলাউদ্দিনের পরাজয় এবং রত্নসেনের মৃত্যু ও পদ্মাবতীর সহমরণ-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রথম অংশ অপেক্ষা দ্বিতীয় অংশে কাহিনীর জটিলতা অনেক বেশি। কিন্তু তা হলেও প্রথমোক্ত প্রেম-কাহিনীটিই আলাওলের প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ এই অংশে আলাওলের কবিত্বশক্তি যেমন স্বচ্ছন্দে ও সহজ গতিতে প্রবাহিত হয়েছে, পরবর্তী অংশের ঐতিহাসিক কাহিনী-বর্ণনায় তা হয় নি। আলাওল যেমন ধর্মগ্রন্থ রচনা করেন নি, তেমনি ইতিহাসও রচনা করেন নি, তিনি রচনা করেছেন কাব্য, যার প্রধান উপজীব্য প্রেম।
প্রতিভা বিচার:
কবি আলাওল খাঁটি কবি ছিলেন বলেই তাঁর হৃদয়ানুভূতির ক্ষেত্র ছিল যেমন প্রসারিত, তেমনি গভীর। একটি প্রসঙ্গের আলোচনাতেই এর স্বরূপ উপলব্ধি করা যাবে। মূল 'পদুমাবতী' কাব্যে মুসলমান-সম্রাট আলাউদ্দিনের জয় প্রদর্শন করা হয়েছে, কিন্তু আলাওলের কাব্যে আলাউদ্দিনের ঘটেছে পরাজয়। কবি সত্যকার কবি বলেই সাম্প্রদায়িকতার নিকট নতি স্বীকার করেন নি। তিনি বৃহত্তর ও মহত্তর মানবধর্মের অনুশাসনে চালিত হয়েছেন। অধ্যাপক শ্রীভট্টাচার্যের মতে, “আলাওল ছিলেন সৌন্দর্যগত-প্রাণ সত্যকার কবি : তাঁহার ধারণা ছিল—বিশ্বজগতে, অন্ততপক্ষে কাব্যজগতে ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়ই চিরন্তন সত্য। কোনোরূপ সঙ্কীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজাতিপ্রীতি তাঁহার এ বিশ্বাস টলাইতে পারে নাই। যে সুলতান অধার্মিক, পরপত্নীলুব্ধ, খামখেয়ালী ইতিহাস তাহাকে বিজয়ী বলিয়া ঘোষণা করিতে পারে, কিন্তু সঙ্গতিপূর্ণ কবি কল্পনার জগতে তিনি পরাজিত হইতে বাধ্য।” আলাওল ছিলেন সূফী-সাধক, এ দিক থেকে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদিগের সঙ্গে তাঁর ভাবগত মিল থাকবার কথা। বস্তুত তাঁর 'পদ্মাবতী' কাব্যে কবির বৈষ্ণব-সমপ্রাণতারই পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র সৌন্দর্যের চিত্র- রচনায় আলাওলের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। জনৈক ঐতিহাসিক আলাওলের 'পদ্মাবতী'কে বাঙলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক রোমান্সের মর্যাদা দান করে বলেছেন, “বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসে সম্ভবতঃ ইহাই প্রথম সত্যকার ব্যক্তি সাহিত্য। এই কাব্যের সূচনায় যেমন কবির ব্যক্তি- জীবনকে, তেমনি কাব্যের মধ্যে কবি-মানসকে সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাওয়া যায়। ... ইহাতে ইতিহাসাংশ থাকিলেও ইহা যথার্থ কাব্য এবং রঘুবংশ, কাদম্বরী প্রভৃতি ক্লাসিক্যাল কাব্যের সম-শ্রেণীতে স্থান পাইবার যোগ্য। সপ্তদশ শতকে রচিত হইলেও ইহা উদার ও সর্বজনীন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র ইহাতে নাই।”
আলাওল-রচিত অন্যান্য গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পূর্বেই প্রদত্ত হয়েছে। এদের সবগুলোই ফারসী ভাষা থেকে অনুদিত এবং 'তোহফা' ছাড়া অন্য গ্রন্থগুলি অনেকটা রোম্যান্টিক-ধর্মী কাব্য। 'তোহফা' ধর্মতত্ত্ব-সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। 'পদ্মাবতী'র তুলনায় আলাওলের অপরাপর গ্রন্থ সর্বপ্রকারেই অনেকটা হীন। হতে পারে, কবির বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কল্পনাশক্তি এবং প্রতিভারও ন্যূনতা ঘটেছিল।