নাথ সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ | কাব্য বিচার | ঐতিহাসিকতা | নাথ সাহিত্যের সম্পূর্ণ পরিচয়
নাথ সাহিত্যের অর্বাচীনতা:
বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের আলোচনা-প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি, ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন যদিও ‘ময়নামতীর গান' এবং 'গোর্খ বিজয়’, নামীয় নাথ-সাহিত্যকে প্রাচীন যুগের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তৎসত্ত্বে এদের স্থান তৎকালে নয়। প্রকৃতপক্ষে এ জাতীয় সাহিত্য বহু পরবর্তীকালেই রচিত হয়েছে। পূর্বোক্ত গ্রন্থগুলিতে প্রধানত মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা-আদি সিদ্ধাচার্যদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবতঃ এঁরা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ ছিলেন; এই নামীয় কোন কোন সিদ্ধাচার্যের রচনারও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। [ দ্রষ্টব্য — 'বৌদ্ধগান ও দোহা'।] ভাষা-সাহিত্যের ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন যে এঁরা সম্ভবত খ্রীঃ দশম-একাদশ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। কিন্তু তাঁদের জীবিতকালেই যে তাঁদের অবলম্বন করে সাহিত্য রচিত হয়েছিল, তা অনুমান করবার কোন সঙ্গত কারণ নেই। বিশেষত যে কোন প্রাচীন সাহিত্যেরই যখন কিছু কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন নাথ-সাহিত্যের কোন প্রাচীন পুথির সার্বিক অপ্রাপ্তি বিস্ময়জনক বৈকি। তা ছাড়া প্রাপ্ত পুথিগুলির ভাষায়ও অপেক্ষাকৃত আধুনিকতার লক্ষণ সুপরিস্ফুট। যে পাণ্ডুলিপিগুলি পাওয়া গিয়েছে, তাদের প্রাচীনতমটিও অষ্টাদশ শতকের শেষপাদে লিখিত। এই সমস্ত কারণে অনুমান করা হয়, নাথ-সাহিত্যের বিষয়বস্তু যদিও প্রাচীন এবং এর মূল কাঠামোটি যদিও প্রাচীনকালেই রচিত হয়ে থাকে, তবুও যে আকারে এদের পাওয়া গেছে, তাতে এদের রচনাকালকে অষ্টাদশ শতকের পূর্ববর্তী বলে মনে করা সম্ভব নয়।
নাথ সাহিত্যের উদ্ভব:
নাথ সাহিত্যের উদ্ভব-সম্বন্ধে সম্প্রতি জনৈক গবেষক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে শৈবধর্ম থেকেই নাথধর্মের উদ্ভব হয়েছে।
“কিন্তু নাথসম্প্রদায়ের গ্রন্থাদি আলোচনা করিয়া ও বিভিন্ন মোহান্তদের সহিত আলোচনা করিয়া আমি তাঁহাদের মূলতঃ শৈব বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছি।” (কল্যাণী মল্লিক )
নাথ সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে কিন্তু উক্তিটির সমর্থন পাওয়া যায় না। নাথ সাহিত্যে শিবও একজন জ্যেষ্ঠগুরু এবং দেবতা বলে স্বীকৃত হলেও অন্যান্য নাথগুরুদের কেউ কেউ তাঁকে তেমন সম্মান দান করেন নি। এমন কি নাথপন্থী কবিরাও তাদের কাব্যে শিবকে খুব শ্রদ্ধার আসনে স্থাপন করেন নি। স্থানে স্থানে বরং শিবকে উপহাস্যাস্পদ করেই তোলা হয়েছে। অতএব, অনুমান হয়, অপর সকল মঙ্গলকাব্যে যেমন অনার্যকুলোদ্ভব দেবদেবীরা শেষ পর্যন্ত শিবের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করে জাতে উঠবার প্রয়াস পেয়েছেন, নাথপন্থীরাও এইভাবে শিবের সঙ্গে যোগযুক্ত হয়ে আগ সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছেন। আসলে নাথধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল বৌদ্ধধর্মের বিকারে এই অনুমানই সঙ্গত। যে আদিম অনার্য সমাজ বহুকাল পূর্বেই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে হিন্দু- বিরোধী মনোভাবের অধিকারী হয়েছিল, কালক্রমে তাদের মধ্যেই নাথধর্মের উদ্ভব হয়। পূর্বসংস্কার তারা তখনও ত্যাগ করতে পারেন নি বলেই একদিকে পৌরাণিক দেব-দেবীরা যেমন তাদের দৃষ্টিতে শ্রদ্ধার আসন লাভ করতে পারেন নি, তেমনি হিন্দু আচার-আচরণও তাদের নিকট হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। তা ছাড়া নাথ সাহিত্যে যাদের শুরুর আসন দান করা হয়েছে, প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের আমরা ‘সিদ্ধাচার্য' নামেই অভিহিত করেছি। এই সিদ্ধাচার্যগণ ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থী সাধক। অতএব, নাথধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধদের যোগাযোগই ছিল ঘনিষ্ঠ—এই অভিমত অনুমান মাত্র নয়। এ বিষয়ে ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্তের সাক্ষ্য অতিশয় মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে :
“The Nath cult seems to represent a particular phase of the Siddha cult of India. THis Siddha cult is a very old religious cult of India with its main emphasis on a psychochemical process of Yoga, known as the Kaya Sadhana or the culture of body with a view to making it perfect and immutable and thereby attaining an immortal spiritual life.’’
এই প্রসঙ্গে আর একটি সূত্রের উল্লেখ প্রয়োজন। এযাবৎ কোন মুসলমান কবি-রচিত কোন মঙ্গলকাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ নাথ সাহিত্য রচয়িতারূপে একাধিক মুসলমান কবির পরিচয় পাওয়া যায়। এই নাথ সাহিত্যে কিংবা নাথ-ধর্মে যে কোন মুসলমানী প্রভাব বর্তমান তাও নয়। তাই অনুমান, যে অনার্য সমাজ থেকে নাথধর্মের উদ্ভব হয়েছে, তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পূর্বসংস্কার ও ঐতিহ্যের জন্যই তারা নাথধর্মের প্রতি কিছুটা পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারেন। অতএব, নাথ ধর্মের উৎপত্তি-সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে হয় যে, এটি মূলত ছিল অনার্য ধর্ম। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবেই এর কাঠামো গঠিত হয়েছিল। আরও পরে শিবকে এই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে এর আর্যীকরণের চেষ্টা করা হয়।
নাথ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য:
প্রাগার্য আদিম জনতা-ধর্মই নাথ সাহিত্যে পরিস্ফুট হলেও উক্ত সাহিত্য-বিশ্লেষণে সূত্রাকারে কতকগুলি বিশিষ্ট লক্ষণের কথা উল্লেখ করতে পারি। অবশ্য এই লক্ষণগুলিকে আর এখন পরিপূর্ণ অনার্যোচিত বলে অভিহিত করবার উপায় নেই, কারণ বৌদ্ধ এবং নাথ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হিন্দুধর্মের কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যেও এদের অস্তিত্ব বর্তমান। সন্ন্যাসজীবনের প্রতি আকর্ষণ অন্য অনেক ধর্মেই বর্তমান, কিন্তু নাথধর্মে এর একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। নাথপন্থীদের ধারণা, যোগসাধনার দ্বারা 'মহাজ্ঞান' লাভ করে মানুষ দৈহিক অমরতা লাভ করতে পারে—এই অমরতা লাভের আকাঙ্ক্ষাই নাথপন্থীদের চরম ও পরম আকাঙ্ক্ষা। এই উদ্দেশ্যেই তাঁরা ব্রহ্মচর্য আচরণ ও সন্ন্যাস গ্রহণ করে থাকেন। এর ফলে এই পথের পথিকদের নিকট নারী-বিদ্বেষও একান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশেষ সাধনাটিকে 'কায়সাধনা' নামে অভিহিত করা হয়। এর উদ্দেশ্য যে কোন আত্মিক বা আধ্যাত্মিক উন্নতিলাভ, তেমন মনে হয় না। কারণ, সন্ন্যাস-আদি অনুষ্ঠানে একদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষুজীবনের প্রভাব পড়েছে, অন্যদিকে হিন্দু বর্ণাশ্রম ধর্মের বিরোধিতাও প্রকাশ পেয়েছে। সহজিয়া সাধনার যে ধারাটি বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণবদের মধ্যে দেখা যায়, নাথপন্থীদের মধ্যেও তা প্রসার লাভ করেছিল। তারাও বেদবিধিসম্মত তথা শাস্ত্রীয় পূজা- আচরণের প্রতি বিশ্বাসী নয়। নাথপন্থীদের আর এক বিষয়ে সমধিক আগ্রহ লক্ষিত হয়, যেটি “সিদ্ধাই লাভ’’ কারণ এর সাহায্যে অলৌকির শক্তির অধিকারী হওয়া সম্ভবপর। নাথ সাহিত্যে এ জাতীয় অলৌকিকতার দৃষ্টান্তও রয়েছে যথেষ্ট।
নাথ সাহিত্য পরিচয়:
নাথ সাহিত্যের দুই ধারা:
নাথ সাহিত্যকে দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত করা চলে, একটি ‘গোর্খবিজয়' বা 'মীনচেতন', অপরটি 'ময়নাবতী' বা 'গোপীচন্দ্রের গান'। প্রথমোক্ত ধারায় গোরক্ষনাথ কর্তৃক আদিগুরু নাথ সাহিত্যের দুই ধারা মীননাথের উদ্ধার কাহিনী বিবৃত হয়েছে। এই ধারার কাব্যসমূহে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠাই প্রাধান্য লাভ করেছে। শেষোক্ত ধারার কাব্যে রাণী ময়নাবতী-কর্তৃক পুত্র গোপীচন্দ্রকে সন্ন্যাসধর্মে প্রবর্তিত করবার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই গোপীচন্দ্রের গানে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অপেক্ষা কাব্যগুণই প্রাধান্য লাভ করেছে।
গোর্খা বিজয়ের কাহিনী:
মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথ আদি নাথশুরু। তিনি পার্বতীর শাপে কদলীর দেশে গমন করলেন এবং তথায় আত্মজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে সংসারধর্মে আসক্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে শিষ্য গোরক্ষনাথ শুনলেন যে শুরু মীননাথ কদলী রাজ্যে নারীর মোহে পড়ে মৃত্যুর পথে অগ্রসর হচ্ছেন। এই সংবাদ পেয়ে গোরক্ষনাথ গুরুকে উদ্ধার করবার আকাঙ্ক্ষায় কদলী রাজ্যে গিয়ে উপনীত হলেন। প্রথম তিনি ব্রাহ্মণের বেশে গেলেন, তাতে কোনো ফল হলো না। পরে তিনি যোগীর বেশ ধারণ করলেন, কিন্তু তাতেও মীননাথের দেখা পেলেন না; সর্বশেষ তিনি নর্তকীর বেশ ধারণ করে মীননাথের সামনে উপস্থিত হলেন। তিনি বিহিত বিধানে মীননাথকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করলেও যখন মীননাথ কেবল আত্মপক্ষ সমর্থন করতে লাগলেন, তখন গোরক্ষনাথ মীননাথের পুত্রকে আছড়ে হত্যা করলেন এবং আবার এক তুড়ি দিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন। এতক্ষণে মীননাথের চেতনা হলো। কিন্তু কদলীর অধিবাসীরা গোরক্ষনাথকে রাক্ষস ভেবে হত্যা করতে সচেষ্ট হলে গোরক্ষনাথ শাপ দিলেন এবং সব কদলী বাদুড় হয়ে উড়ে গেল। এইবার গোরক্ষনাথ গুরু মীননাথকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন।
কাব্য বিচার:
নাথ পন্থীদের আদিগুরু মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ সম্ভবত ঐতিহাসিক ব্যক্তি। কেউ কেউ এঁকে সিদ্ধাচার্য লুই-পা (রোহিত পাদ) বলে মনে কারে থাকেন। লুই-পার রচিত প্রাচীন বাঙলা পদ চর্যাপদের অন্তর্ভুক্ত। গোরক্ষনাথও ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তাঁর রচিত সংস্কৃত ‘গোরক্ষ-সংহিতা' বিদ্যমান। গোরক্ষনাথ যদি বাঙলাদেশের অধিবাসীও হয়ে থাকেন, তবু একসময় সারা ভারতবর্ষেই তাঁর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল এবং সর্বত্র তাঁর শিষ্যমণ্ডলীও বর্তমান ছিল। কিন্তু তাঁদের অবলম্বন করে যে কাহিনী রচিত হয়েছে, তা উপকথারই তুল্য। এতে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলেছিল বলেই কাহিনীতে অলৌকিকত্বের এবং অস্বাভাবিকতার অভাব নেই। এমন কি গোরক্ষনাথের কেরামতি দেখাবার জন্য দাম্ভিকতা, কুটিলতা এবং হিংস্রতারও যথেষ্ট প্রশ্রয় দান করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আশঙ্কা হয়, গ্রন্থটি সম্বন্ধে নিরাসক্ত আলোচনা বিশেষ হয় নি। একপক্ষ যেমন উচ্ছ্বসিতভাবে কাহিনীটির প্রশংসা করেছেন, অপরপক্ষ তেমনি তীব্র ভাষায় এর নিন্দা করেছেন। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন গোরক্ষনাথের চরিত্রকে শরৎ-শেফালী বা যুথিকার ন্যায় শুভ্র বলে অভিহিত করেছেন। ডঃ সুকুমার সেন গোরক্ষনাথ কর্তৃক গুরু মীননাথের চৈতন্যসম্পাদনকে সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের একটি মহনীয় কাহিনী বলে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে অধ্যাপক শ্রীভট্টাচার্যের মতে গোরক্ষচরিত্রে
“নাথসংস্কারের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা ছাড়া অপর কোন গুণ নেই – যা আছে তা আকাশস্পর্শী দত্ত, অহংকার, ক্রুরতা, হৃদয়হীনতা, ক্রোধ ও প্রতিহিংসা।”
তিনি মীননাথের চৈতন্য সম্পাদন-কাহিনী সম্বন্ধে বলেছেন, বিশ্বাসাহিত্যের ইতিহাসে এইরূপ বীভৎস কাহিনী অদ্বিতীয়। অধ্যাপক শ্রীভট্টচার্য ‘গোরক্ষবিজয়' সম্বন্ধে অতিশয় নিষ্ঠুর মন্তব্য করেছেন :
“সাহিত্য-বিচারে গোর্খবিজয় হইতেছে অন্ধ তমসাবৃত প্রেতরাজ্য। অতিমানবীয় জড়শক্তিই ইহার অধিপতি। এখানে স্নেহ নাই, প্রেম নাই, ভক্তি নাই, হৃদয়স্পন্দনের কোন চিহ্ন নাই, এই জগতে বহিঃপ্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, ঈশ্বরের বিধান অস্বীকার করিয়া দৈহিক অমরতার লোভে নাথধর্ম এখানে স্থাণু হইয়া বসিয়া আছে... এই জগতের জীবন দানবীয়, ভাষা হেঁয়ালী, উচ্চার্য ডাকিনীমন্ত্র। একটা অস্পষ্টতা ও রহস্যের ধূমল ছায়া ইহাকে হিম শীতল মৃত্যুপুরীতে পরিণত করিয়াছে।”
“গোরক্ষবিজয়' কাব্য যে জীবনবিমুখ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রথমত স্মরণ রাখা দরকার যে ধর্ম-প্রতিষ্ঠার জন্যই নাথপন্থীদের এই কাহিনী গঠন করতে হয়েছে; এতে গোরক্ষনাথের চরিত্রে হিংস্রতা আদি সবকিছুই বর্তমান। কিন্তু যে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে করে তাদের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য সচেষ্টা হতে হয়েছে, তার কথা বিবেচনা করলে একে কাব্যের একটা অসাধারণ অপরাধ বলে মনে করা চলে না। মঙ্গলকাব্যসমূহে দেবতাদের যে হিংস্রতা, নীচতা ও কুটিলতার পরিচয় পেয়ে থাকি, তার তুলনায় গোরক্ষনাথ এমন বেশি কিছু অপরাধ করেন নি। 'গোরক্ষবিজয়ে' দেবতার স্থান নেই, গোরক্ষনাথ নিজেই এখানে দেবতার আসন গ্রহণ করেছেন। অতএব দেবতার কাজ তাঁকে দিয়ে সেরে নিতে হয়েছে। তবে একে যদি ঐতিহাসিক কাব্য বলে বিচার করতে হয়, তবে অবশ্যই গোড়াতেই গণ্ডগোল থেকে যাবে, কারণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে কাব্যে উপকথাই রচিত হয়েছে।
কাব্য পরিচয়:
পূর্বেই বলা হয়েছে মীননাথ এবং গোরক্ষনাথ ঐতিহাসিক পুরুষ হলেও 'গোরক্ষবিজয়' কাব্যটি একান্তই অর্বাচীন কালে রচিত হয়েছে। তবে গোরক্ষনাথের অলৌকিক লীলাকাহিনী এবং মীনচেতন-কাহিনী যে বহু পূর্বেই সর্বভারতে বিস্তার লাভ করেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র গোর্খ-পন্থী যোগী বা যুগী সম্প্রদায় বর্তমান। পশ্চিম ভারতেও মীনচেতন-সম্বন্ধীয় ছড়া প্রচলিত আছে। বাঙলা ভাষায় অষ্টাদশ শতাব্দীতে সহদেব চক্রবর্তী- রচিত 'অনিলপুরাণে'ই (তাহা দ্রষ্টব্য ) সর্বপ্রথম 'মীনচেতন' কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মৌলবী আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদই সর্বপ্রথম 'গোধবিজয়' নামক পৃথক গ্রন্থ উদ্ধার করে তা প্রকাশ করেন। তিনি যে সমস্ত পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থটি সম্পাদন করেছিলেন, তাদের প্রাচীনতমটি ১৭৭৮ খ্রীঃ লিখিত। গ্রন্থের ভণিতায় ভীমদাস, ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, কবীন্দ্র দাস এবং ফৈজুল্লার নাম পাওয়া যায়। অধিকাংশ পাণ্ডুলিপিতেই ফয়জুল্লার নাম পাওয়া যায়, অপরদের নাম কোন কোনটিতে বর্তমান। এদের কে বা কারা গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। শ্যামদাস, ভীমদাস বা কবীন্দ্র-সম্বন্ধে কোন সংবাদ পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ফয়জুল্লা নামক একজন কবি বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। হয়তো ইনিই এই গ্রন্থটিরও রচয়িতা হতে পারেন।
গোপীচন্দ্রের গানের কাহিনী:
‘গোরক্ষবিজয়ের তুলনায় ময়নামতী বা গোপীচন্দ্রের গানে মানবিক আবেদন অপেক্ষাকৃত বেশি। জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা শিবের শাপে হাড়ি হয়ে গোপীচন্দ্র বা- গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যে হীনকর্মে নিযুক্ত ছিলেন। রাজমাতা ময়নামতী ছিলেন সিদ্ধা, তিনি তা জানতে পেরে গোবিন্দচন্দ্রকে হাড়ির নিকট থেকে দীক্ষা নিতে আদেশ করলেন। কিন্তু হাড়ির নিকট থেকে দীক্ষা নিতে গোবিন্দচন্দ্র অসম্মত হলে রাণী ময়নামতী আপন সিদ্ধাই দেখালেন। তখন গোপীচন্দ্র হাড়িপার নিকট দীক্ষা চাইলেন। ছাড়িপা গোপীচন্দ্রকে পরীক্ষা গোপীচন্দ্রের গানের কাহিনী করতে চেয়ে তাকে ভিক্ষায় পাঠালেন। গোপীচন্দ্র গুরুর সঙ্গে দেশ- দেশান্তরে ভ্রমণ করতে লাগলেন। শেষে গোপীচন্দ্রকে হীরা নামক এক বারাঙ্গনার কাছে বাঁধা রেখে হাড়িপা চলে এলেন। বারো বৎসর পর হাড়িপার এ কথা মনে পড়লে তিনি গোপীচন্দ্রকে উদ্ধার করে আনলেন। এইবার গোপীচন্দ্র রাণী অদুনা ও পদুনার পরামর্শে হাড়িপাকে মাটির নীচে পুঁতে রাখলেন। হাড়িপার শিষ্য কানুপা বহুকাল গুরুর সন্ধান না পেয়ে গোরক্ষনাথের নিকট শুনলেন যে গুরুকে মাটির নীচে পুঁতে রাখা হয়েছে। কানুপা শিশুর মূর্তি ধারণ করে গোপীচন্দ্রের রাজ্যে উপনীত হয়ে আপন সিদ্ধাই দেখালেন। গোপীচন্দ্র তার শরণ নিয়ে হাড়িপাকে মুক্ত করলেন। এর পর রাজা গোপীচন্দ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করে অমর হলেন। রাণী ময়নামতীও পরম সুখ অনুভব করলেন।
কাব্য বিচার:
এই কাহিনীর মধ্যেও 'গোরক্ষবিজয়ে'র মত অলৌকিকত্ব এবং আজগুবি কাহিনীর ছড়াছড়ি। জনৈক সমালোচকের মতে,
“শিশুচিত্ত লইয়াই ইহার কাহিনী অনুধাবন করিতে হইবে। দেবতা ভূত পশু কাঁট উদ্ভিদ সকলেই এখানে মানুষের সহচর ও সমধর্মী, কোন অলৌকিকতাই এখানে অবিশ্বাস্য নহে। কেবল অলৌকিকতা নহে, রূপকথার আঙ্গিক ও বর্ণনাও গোপীচন্দ্রের গানে দেখা যায়।”
কিন্তু তৎসত্ত্বেও গোপীচন্দ্রের গান অপেক্ষাকৃত মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ। ময়নামতী প্রথমাবধি পুত্র গোপীচন্দ্রকে সন্ন্যাসী সাজাবার চেষ্টা করছেন, সঙ্গে সঙ্গে আপন ঘরে তার প্রতিক্রিয়াটুকুও স্বরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন। গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণ-কালে অদুনা-পদুনার অন্তর্ভেদী বিলাপের মধ্য দিয়ে অন্তত অলৌকিক ক্ষমতার মাহাত্ম্যও মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকা যায়। তদুপরি রচনার ফাঁকে ফাঁকে কবিরা যেন বাস্তবে নেমে এসেছেন আর সেই অবসরে বাস্তব জীবনানুভূতিরই পরিচয় দান করেছেন। গ্রন্থটির ভালোমন্দ বিচার করে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ মন্তব্য করেছেন :
“যে সমাজের পটভূমিকায় কাহিনীটি বিন্যস্ত হইয়াছে তাহা হিংস্র, ক্রুর, বর্বরোচিত প্রবৃত্তির অমার্জিত উচ্ছ্বাসে অসংবৃত ভোগ-লালসায়, শৈশবসুলভ উদ্ভট কল্পনার আতিশয্যে এবং সমাজ ও পরিবার-জীবনের রূঢ়, সুষমাহীন ছন্দে এক অর্ধ- সভ্য, অপরিণত সংস্কৃতি ও জীবনবোধেরই পরিচয় বহন করে। এই অশিক্ষিত, আদিম সংস্করাচ্ছন্ন সমাজ হইতেও যে এরূপ উন্নত, যথাযথ ভাব প্রকাশক্ষম, সূক্ষ্ণ তত্ত্ব পরিস্ফুট করিতে নিপুণ, কাব্যগুণসমৃদ্ধ রচনার প্রেরণা আসিয়াছে ইহাই বাঙালী-জীবনের এক চিরন্তন বিস্ময়।"
ঐতিহাসিকতা:
‘গোপীচন্দ্রের গানে'র মূল কাহিনীটিকে অনেকেই বাস্তবতার কাঠামোয় গঠিত বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে তা' থেকে ইতিহাস উদ্ধার করতে গেলে বিড়ম্বনাই সার হবে। তবে এ কথা সত্য যে গোপীচন্দ্রের কাহিনীর উদ্ভব বাঙলাদেশে। উড়িষ্যার রাজেন্দ্র চোলের (১০৬৩ খ্রীঃ ১১১২ খ্রীঃ) এক শিলালিপিতে বঙ্গরাজ গোবিন্দচন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। কেউ কেউ এঁকেই আলোচ্য গোবিন্দচন্দ্র বা গোপীচন্দ্র বলে মনে করেন। কেউ বা অনুমান করেন, নাথ সাহিত্যে উক্ত গোপীচন্দ্র আরও বহু পূর্ববর্তীকালে বর্তমান ছিলেন। যা হোক, তিনি যে বাঙালী ছিলেন তা ঐতিহ্যসম্মতও বটে। ভারতবর্ষের সর্বত্র গোর্খপন্থী ভিক্ষুকরা একতারা বাজিয়ে যে গোবিন্দচন্দ্রের সন্ন্যাসের গান গেয়ে থাকে, তাতে ওঁকে বঙ্গেশ্বর বলেই অভিহিত করা হয়। গুজরাটে প্রচলিত কাহিনীতে গোপীচন্দ্রের পিতাকে গৌড়বঙ্গের অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পাঞ্জাবী কাহিনীতেও গৌড়বঙ্গালকে গোপীচন্দ্রের জন্মভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গোপীচন্দ্রের কাহিনীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ষোড়শ শতকে রচিত মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দী 'পদুমাবৎ' কাব্যে। নেপাল থেকে বাঙলা ও নেওয়ারী ভাষায় লিখিত একটি নাটক উদ্ধার করা হয়েছে, এর বিষয়বস্তু 'গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস'। এতেও গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রকে বঙ্গের অধিপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রন্থটি অন্তত সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত। কাজেই মূল কাহিনী যে ষোড়শ শতাব্দীর বহুপূর্বেই ঘটে গিয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্ত অনুমান করেন,
“Stories of Gorakhnath and Gopicand, at least the skeleton of such, had been in all probability, current in Bengal (and not only in Bengal, but in many other parts of India) before the time of conquest of Bengal by the muslims in the thirteenth century.’’
স্যার জর্জ গ্ৰীয়ার্সন ১৮৭৩ খ্রীঃ সর্বপ্রথম এই জাতীয় একটি কাব্য আবিষ্কার করে 'The song of Manikchandra' নামে প্রকাশ করেন। গোপীচন্দ্রের পিতার নামই মাণিকচন্দ্র। এ বিষয়ে যত পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের মধ্যে প্রাচীনতমটি ১৭৯৯ খ্রী: লিখিত। মনে হয় কবি দুর্লভ মল্লিকই গোপীচন্দ্রের গানের আদি কবি। দুর্লভ মল্লিকের রচনার ভাষা অনেকটা প্রাচীন, সহজ ও সরল। তাঁর রচিত কাহিনীতে অপেক্ষাকৃত সুরুচি ও সংযমের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দুর্লভ মল্লিক তাঁর কাব্যে আত্মপরিচয় দান না করায় তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানবার উপায় নেই। এই কাব্যের অপর দু'জন কবি ভবানীদাস ও সুকুর মামুদ। এঁরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অথবা ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই তত্তৎ কাব্য রচনা করেছিলেন বলে অনুমিত হয়। ভবানীদাস সম্ভবত পূর্ববঙ্গের এবং সুকুর মামুদ উত্তরবঙ্গের কবি ছিলেন। এর অধিক এঁদের সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তাঁদের উভয়ের কাব্যেই কিছু কিছু কাহিনী গত বৈশিষ্ট্য বর্তমান।