অপভ্রংশ ভাষা ও সাহিত্যিক নিদর্শন | All about Apabhranśa Language




অপভ্রংশ ভাষা:

অপভ্রংশ ভাষার আনুমানিক স্থিতিকাল ৬০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ। এটিই মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার শেষ স্তর। পঞ্চম শতক থেকেই লোকমুখে প্রাকৃত ভাষাগুলো পাল্টে পাল্টে সহজ হতে থাকে এবং এগুলো—মাগধী প্রাকৃত > মাগধী অপভ্রংশ; মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত > মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ; শৌরসেনী প্রাকৃত > শৌরসেনী অপভ্রংশ; পৈশাচিক প্রাকৃত > পৈশাচিক অপভ্রংশ এবং অর্ধমাগধী প্রাকৃত > অর্ধমাগধী অপভ্রংশ রূপে পরিচিতি লাভ করে। অপভ্রংশ শুধু ভারতীয় আর্যের শেষ স্তর নয়, পণ্ডিতেরা একদা আলাদা ভাষা মনে করতেন। সাধারণ ভাবে এর নাম দেওয়া হয়েছে—'লৌকিক' ভাষা বা অশিক্ষিত লোকেদের কথ্য ভাষা। পতঞ্জলির অনুসরণে পণ্ডিত গ্রিয়ার্সন এই স্তরটির নাম দিয়েছেন ‘অপভ্রংশ। প্রাকৃত ভাষাগুলো এবং ভারতীয় আর্য ভাষার শেষ স্তরের (বাংলা, হিন্দী প্রভৃতি) মধ্যবর্তী কালে অপভ্রংশের অবস্থান কল্পনা করা হয়েছে। এই লৌকিক ভাষা বা অপভ্রংশ একদা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সংস্কৃতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত উত্তরভারত, গুজরাট থেকে আসাম পর্যন্ত লোকসাহিত্যের প্রধান বাহন হিসেবে জনমনে একচেটিয়া ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। শুধু লোকসাহিত্য নয়, ধর্মালোচনা, কাব্য রচনাও হয়েছে। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জৈন, বৌদ্ধ ও নাথপন্থার সন্ন্যাসীরা। মোটামুটিভাবে অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে অপভ্রংশের খোলস ত্যাগ করে অধিকাংশ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলো জন্ম নেয়। বাংলা ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ভাষা।

নিদর্শন:


 রচনা নিদর্শন অপভ্রংশে বিপুল। জোইন্দু, পুষ্প, দন্ত, ধনপাল, হরিভদ্র প্রমুখের সাহিত্যিক চেতনা উল্লেখযোগ্য। সমাজের নিম্নস্তরে বৃহত্তর জনসমষ্টির লোককবিরা লৌকিক সাহিত্য রচনায় ব্যবহার করতেন অপভ্রংশ ভাষা। মাগধী ও শৌরসেনী দুটো প্রাকৃতের অপভ্রংশই কাব্য রচনাতে ব্যবহৃত হয়। বহুজন ব্যবহৃত এই দুটি অপভ্রংশের প্রভাব জনসমাজে ছিল ব্যাপক। সমগ্র উত্তরভারতে শৌরসেনী অপভ্রংশ ব্যাপক প্রচার লাভ করে। বঙ্গদেশে সহজযানী বৌদ্ধ কবিরা, কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কবিও অপভ্রংশে কাব্যরচনা করেন। কাহ্নপাদ, সবরপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্য প্রসিদ্ধ দোহাগুলো লিখেছেন শৌরসেনী অপভ্রংশে। মৈথিলি কোকিল বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’ কাব্য শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত। জয়দেবের সংস্কৃত গ্রন্থ 'গীতগোবিন্দ'-র কোনো কোনো অংশ নিয়ে মতভেদ হলেও, তিনি যে অপভ্রংশে গীতিকবিতা রচনা করতেন, সে প্রমাণ ভাষাচার্য সুনীতিকুমার দিয়েছেন। সংস্কৃতের তুলনায় অপভ্রংশে সহজ, সরল, নিরক্ষর জনও কানে শুনে অবধারণ করতেন বলেই এই ভাষা কাব্য রচনার বাহন হয়ে ওঠে। বাঙালী কবিদের অনেক রচনাতে সমকালীন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভাবনা- কল্পনা কাব্যময় রূপ নেয়। জনতার ভাষা হিসেবে সংস্কৃতের সর্বাপেক্ষা বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। অপভ্রংশে অজস্র টুকরো কবিতা রচিত হয়। এরূপ গীতিকবিতার একটি সংকলন 'প্রাকৃত পৈঙ্গল' গ্রথিত হয় চতুর্দশ শতকে। এগুলো সবই তুর্কী আমলের পূর্বে রচিত। এখানে প্রেম, ভক্তি, বীর, বাৎসল্যরস স্থান পেয়েছে। লৌকিক, রাধাকৃষ্ণ, রামচন্দ্র, শিব-পার্বতীদের নিয়ে অনেক কবিতা আছে। এগুলো পরে বড়ু চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন', রামচন্দ্রের 'শিবায়নে' এবং নানা মঙ্গলকাব্যে বিস্তৃত, ঘনীভূত হয়েছে। “সেকশুভোদয়া” কাব্যও অপভ্রংশে রচিত। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে পশ্চিম পাঞ্জাবের কবি আব্দর রহমান একটা বৃহৎ 'দূত' কাব্য লেখেন, কাব্যটির নাম “সংনেহয়রাসক’। সম্ভবত এটাই অপভ্রংশে রচিত সর্বশেষ রচনা। এছাড়া ডাক- খনার বচনের প্রবাদ সংগ্রহ, শুভঙ্করের নামে প্রচলিত গণিত-আর্যার শ্লোকগুলো মূলত অপভ্রংশে রচিত, পরে লোকমুখে বাংলায় পরিণত হয়েছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন