জাতিসংঘ ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা

ভূমিকা

বিশ শতকের বিশ্ব-রাজনীতিতে দুটি মহাযুদ্ধের পরেই বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রচেষ্টা দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসঙ্ঘ (League of Nations) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO) এই প্রচেষ্টার দুটি সমধর্মীয় পদক্ষেপ। উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেক মিল পরিলক্ষিত হয়, দোষ-গুণ উভয়ের মধ্যে একইরূপ দেখা যায়। একই কারণেই অনেক ঐতিহাসিক জাতিপুঞ্জকে জাতিসংঘের একটি অনুকরণ মাত্র বলে মনে করেন এবং উভয়ের মধ্যে কোনো মূলগত পার্থক্য নেই। ঐতিহাসিক Schuman বলেছেন, “The United Nations Organisation is the League of Nations in a new guise," কিন্তু এই অভিমত সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য নয়। জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জের মধ্যে যেমন অনেক মিল আছে, তেমনি অনেকক্ষেত্রে পার্থক্যও আছে।

🔘সামঞ্জস্য : 


উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, (১) উভয়েই যুদ্ধকে রোধ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, উভয়েই বিশ্বশান্তি রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, (২) উভয় সংগঠনেই বিজয়ী শক্তিবর্গের প্রাধান্য বজায় রাখা হয়েছিল। (৩) উভয় সংস্থাই আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য প্রথমে আলাপ-আলোচনা, মধ্যস্থতা প্রভৃতি পন্থা গ্রহণের নীতি স্বীকার করেছে। (৪) উভয় প্রতিষ্ঠানই তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একই ধরনের কয়েকটি সংস্থা গড়ে তুলেছে, যেমন লিগের কাউন্সিল, এসেম্বলী ও স্থায়ী আন্তর্জাতিক বিচারালয়; সেইরূপ জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ সভা ও আন্তর্জাতিক আদালত। (৫) এমন কি জাতিপুঞ্জের অছি পরিষদ ও লিগের ম্যান্ডেট ব্যবস্থারই অনুরূপ। সুতরাং দেখা যায় যে, উদ্দেশ্য ও সংগঠনের দিক দিয়ে উভয় প্রতিষ্ঠানের মে অনেকখানি সামঞ্জস্য রয়েছে।

🔘পার্থক্য : 


উপরোক্ত কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য অনেক বিষয়ে উভয় সংগঠনের মধ্যে অমিল দেখা যায়। এই সমস্ত পার্থক্য লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, সাধারণত জাতিপুঞ্জ সংগঠন ও লক্ষ্যের দিক থেকে জাতিসংঘের চেয়ে উন্নত হলেও, কয়েকটি ক্ষেত্রে সে কোনো অগ্রগতি দাবি করতে পারে না। পার্থক্যগুলি মোটামুটিভাবে হল এইরূপ—

◼️ (১) লিগ চুক্তি ভার্সাই শান্তি-চুক্তির অংশ মাত্র :

জাতিসংঘের চুক্তিপত্র (League Covenant) ভার্সাই-এর শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল অর্থাৎ শান্তি-চুক্তির ভাগ্যের সঙ্গে ওই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জাতিপুঞ্জের সনদ (Charter) এরূপ কোনো শান্তি চুক্তির অংশ নয়, এর স্বাধীন অস্তিত্ব এটির কার্য পরিচালনার সহায়ক।

◼️ (২) জাতিপুঞ্জের বিভিন্ন সংস্থায় ক্ষমতা ন্যস্ত :

জাতিসংঘের ক্ষেত্রে ক্ষমতা একটু বেশি কেন্দ্রীভূত ছিল কিন্তু জাতিপুঞ্জের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার ওপর ক্ষমতা বিতরিত হবার কলে কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

◼️ (৩) জাতিপুঞ্জে বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ : 

জাতিসংঘ যখন সৃষ্টি হয় তখন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া প্রভৃতি কয়েকটি রাষ্ট্র এটির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু জাতিপুঞ্জে প্রায় সমস্ত বৃহৎ রাষ্ট্রই অংশ গ্রহণ করার ফলে এর মর্যাদা ও প্রভাব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। 

◼️ (৪) জাতিপুঞ্জের ভিত্তি; বিশ্বের মানবগোষ্ঠী :

জাতিসংঘের চুক্তিপত্রের লক্ষ্য হিসাবে বিভিন্ন সরকার এবং তাদের উন্নতির বিষয়টিই উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু জাতিপুঞ্জের সনদে পৃথিবীর 'মানব গোষ্ঠীর উন্নতিসাধনকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি জাতিপুঞ্জকে অধিকতর। গণতান্ত্রিক রূপদান করেছে এবং তার ভিত্তি বিশ্ব জনগণের শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।

◼️ (৫) ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা: 

এটি নিঃসন্দেহ যে, জাতিসংঘের চাইতে জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্যগুলি অনেক বেশি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারসমূহের ওপর জাতিপুঞ্জ যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে।

◼️ (৬) মানবিক অধিকার : 

সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ হল জাতিপুঞ্জ কর্তৃক বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দায়িত্ব গ্রহণ করা। এটাই ভবিষ্যতে প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টির সহায়ক হবে। জাতিসংঘ এইক্ষেত্রে নীরব ছিল।

◼️ (৭) সংগঠনগত ব্যাপার : 

লিগের কাউন্সিল ও সাধারণ সভার মধ্যে ক্ষমতা পৃথকভাবে নির্দিষ্ট ছিল না। কিন্তু জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তার পরিষদের মধ্যে ক্ষমতা পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ফলে উভয় সংস্থারই কার্য পরিচালনা সহজ হয়েছে।

◼️ (৮) বিভিন্ন সংস্থার ক্ষমতা নির্দিষ্ট : 

লিগের কোনো সংস্থায় কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হলে উহা সর্ববাদীসম্মত হওয়ার প্রয়োজন ছিল; এতে দ্রুত কর্তব্য সম্পাদান ব্যাঘাত সৃষ্টি হত। জাতিপুঞ্জ তার বিভিন্ন সংস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতি অবলম্বন করে এই দুর্বলতা দূর করেছে।

◼️ (৯) যুগ্ম-নিরোধ সংক্রান্ত দায়িত্ব : 

যুদ্ধ-নিরোধ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনেও উত্তর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিদৃষ্ট হবে। জাতিপুঞ্জের সনদে যুগ্ম-নিরাপত্তা (Collective Security) নীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে অধিক। আক্রমণাত্মক যুদ্ধ বা যুদ্ধ-ভীতির সৃষ্টি হলেই জাতিপুঞ্জ হস্তক্ষেপ করার অধিকার পেয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘ কেবলমাত্র আক্রন সংঘটিত হলেই হস্তক্ষেপ করতে পারত।

◼️ (১০) যৌথ-নিরাপত্তার ব্যবস্থা : 

জাতিসংঘে সদস্য রাষ্ট্রগুলির আত্মরক্ষার বিষয়ে বা ওই উদ্দেশ্যে যৌথ নিরাপত্তা গড়ে তোলা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই। কিন্তু জাতিপুঞ্জ এই সকল অধিকার স্বীকার করে নিয়েছে।

◼️ (১১) সামরিক কমিটি : 

জাতিসংঘের নিজস্ব পরিচালনায় সামরিক পন্থা গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু জাতিপুঞ্জের অধীনে একটি সামরিক কর্মচারী সমিতি (Military Staff Committee) গঠিত হয়েছে। কোনো দোষী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সময় জাতিপুঞ্জ এই কমিটির মাধ্যমে তা করতে পারবে।

◼️ (১২) জাতিপুঞ্জের অপকর্ষতা : 

কোনো কোনো বিষয়ে অবশ্য জাতিসংঘের তুলনায় জাতিপুঞ্জ মোটেই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সদস্য-রাষ্ট্রবর্গের দায়িত্ব যেরূপ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, জাতিপুঞ্জের সনদে সেরূপ নেই। সেখানে এটি সাধারণভাবে বর্ণিত আছে।

◼️ (১৩) সদস্যরাষ্ট্রবর্গের দায়িত্ব : 

আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের করার কিছু নেই। কিন্তু লিগের চুক্তিপত্র অনুযায়ী এ সব ক্ষেত্রে সভ্য রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা ছিল। তারা আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত।

◼️ (১৪) নিরস্ত্রীকরণ সমস্যা : 

সর্বশেষে এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে লিগের চুক্তিপত্রে নিরস্ত্রীকরণ নীতিকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রধান উপায় হিসাবে গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু জাতিপুঞ্জে তা গৃহীত হয়নি।

◼️ উপসংহার: 

পরিশেষে উল্লেখ করা দরকার যে, জাতিসংঘ যেখানে ছিল মূলত ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান, জাতিপুঞ্জ সে স্থলে সমগ্র বিশ্বের প্রতিষ্ঠানরূপে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া, জাতিপুঞ্জ যুদ্ধ নিরোধের ব্যাপারে অনেকবেশী কার্যকরী সংগঠন হিসাবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু দুটি সংগঠনের মধ্যে অনেক মূলগত মিল আছে, লিগ-অফ-নেশনস্ -এর ভিত্তির ওপরই জাতিপুঞ্জ রচিত হয়েছে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ