হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন : রচনাধর্মী জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এযাবৎ জানা ছিল আর্য সভ্যতাই ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্যের ফলে এ ধারণা যে ভুল তা যেমন প্রমাণ হয়েছে, তেমনি ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
(ক) সামাজিক জীবন :
প্রথমত, শহরের মধ্যস্থলে পাকা বাড়ি ও প্রান্তসীমায় কুঁড়েঘর বা কাঁচা বাড়ির অবস্থান দেখে হরপ্পা সভ্যতায় ধনী-দরিদ্রের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করা যায়। সমাজে প্রভাবশালী শ্রেণি ছিল ধনী, পুরোহিত, বণিক ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। শ্রমিকরা ছিল পুরোহিত ও ধনী সম্প্রদায়ের ক্রীতদাস। ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ডের মতে, হরপ্পায় শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয়ত, সুতি ও পশমের দুই অংশবিশিষ্ট পোশাকের প্রচলন ছিল। নারী পুরুষ উভয়েই অলংকার পরিধান করত। নারীদের প্রধান অলংকার ছিল কানপাশা, কোমরবন্ধ ও কণ্ঠহার।
তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে প্রধান ছিল কুঠার, বর্শা, তিরধনুক ইত্যাদি।
চতুর্থত, এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনা স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্য সচেতনতারও পরিচয় বহন করে।
পঞ্চমত, হরপ্পা সভ্যতার জনসংখ্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। অনেকের মতে হরপ্পার অধিবাসীরা ছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার। হরপ্পা সভ্যতায় রক্ষণশীলতা অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়েছিল।
(খ) অর্থনৈতিক জীবন :
প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ মানুষ কৃষিকার্যে নিযুক্ত থাকত। প্রধান খাদ্যশস্য ছিল ধান, গম, যব ও নানা জাতীয় বাদাম।
দ্বিতীয়ত, মুরগি, পশুমাংস ও মাছ খাদ্যদ্রব্য হিসাবে ব্যবহ তৃতীয়ত, পশুপালন হরপ্পাবাসীর এক বড়ো পেশা ছিল। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল গোৰু, মহিষ, হাতি, শূকর ও উট।
চতুর্থত, ভারতবর্ষ ও তার বাইরের নানাস্থানের সঙ্গে এদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। তামা, হাতির দাঁত, সুতিবন্ধ ও তুলো ছিল প্রধান রপ্তানি পণ্য। লোথাল ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দর। কিট, সুমেরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে স্থলপথ ও জলপথে বাণিজ্য চলত। নৌকা ও জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে তাদের বাণিজ্যযাত্রার প্রমাণ পাওয়া যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষিজমির অপ্রতুলতার জন্য সম্ভবত খাদ্যশস্য ও আমদানি করা হত।
পঞ্চমত, হরপ্পার মৃৎশিল্পের স্বকীয়তা ছিল। মৃৎশিল্পের বৈশিষ্ট্য হরপ্পা সভ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ষষ্ঠত, স্বর্ণকারেরা সোনা ও রূপার নানা অলংকার তৈরি করত।
সপ্তমত, হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত স্থাপত্য শিল্প ও পাকা বাড়ির নির্মাণকৌশল দেখে অনুমান করা যায় যে, এখানে অনেকেই রাজমিস্ত্রির কাজ করত।
অষ্টমত, শহরগুলিতে বিভিন্ন দোকান থেকে দ্রব্যাদি বিক্রয় করা হত। মহেন-জো-দারো ও হরপ্পায় আবিষ্কৃত পানীয় বস্তু ও স্তূপীকৃত মাটির ভাড় খুচরা বিক্রেতার দোকান শনাক্ত করা যায়।
(গ) ধর্মীয় জীবন :
প্রথমত, সিলমোহরে নারীমুর্তিরর আধিক্য দেখে মনে হয় মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। যে তিনমুখবিশিষ্ট মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তা সম্ভবত শিবের।
দ্বিতীয়ত, দেবদেবী জ্ঞানে তারা সম্ভবত গাছ, পাথর, অগ্নি ও পশু-পাখির পুজো করত।
তৃতীয়ত, হরপ্পায় একটি বড়ো আকারের কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে অনুমিত হয় যে, মৃতদেহ সমাধিস্থ করার প্রথা ছিল।
চতুর্থত, দেবালয় আবিষ্কৃত না হলেও অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন যে অন্যান্য সভ্যতার ন্যায় হরপ্পা সভ্যতাতেও শক্তিশালী পুরোহিত শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল।