বান, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, সাপ, বাঘ, রাজরোগ প্রভৃতির অত্যাচারে মধ্যযুগের বাঙালী যতই জর্জরিত হয়েছে, ততই নানা লৌকিক দেবদেবীর শরণাপন্ন হয়ে অব্যাহতির প্রার্থনা জানিয়েছে। এই লৌকিক দেবদেবীর মহিমা কীর্তন উপলক্ষ করেই গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম শাখা—মঙ্গলকাব্য।
মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গলই সবচেয়ে প্রাচীন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা বিজয় গুপ্ত ও বিপ্রদাস পিপিলাই-এর মনসামঙ্গল পাওয়া গিয়েছে। অন্য কোন মঙ্গলকাব্যের এত প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
এদের মধ্যে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল (বা পদ্মাপুরাণ) বাংলার জনপ্রিয় কাব্যগুলির মধ্যে অন্যতম। পূর্ববঙ্গে এই কাব্যের জনপ্রিতা এত বেশি হয়েছিল যে গায়েনদের হাতে পড়ে মূল রচনা একান্ত বিকৃত হয়ে পড়েছে এবং তার সঙ্গে অন্য কবিদের রচনা এসে মিশেছে। এ দিক দিয়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণের সঙ্গে এই বই-এর তুলনা চলে।
কিন্তু এই বই-এর রচনাকাল সম্বন্ধে গবেষকদের মধ্যে এখনও মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার কারণ এর পুথি খুবই দুর্লভ এবং বিভিন্ন ছাপা বইতে বিভিন্ন রচনাকালবাচক শ্লোক পাওয়া যায়। তাই অনেকে এইসব শ্লোকের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। এসম্বন্ধে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমরা বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলের সবচেয়ে পুরোনো। মুদ্রিত সংস্করণটির সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করব। ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে বরিশাল থেকে রামচরণ শিরোরত্ন এই সংস্করণ প্রকাশ করেন। এতে তিনখানি পুথি ব্যবহৃত হয়েছিল। একখানি ১১৮৯ সন বা ১৭৭৪-৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, দ্বিতীয়টি ১৭২০ শক বা ১৭৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দের এবং তৃতীয়টি ১৭৯৪ শক বা ১৮৭২-৭৩ খ্রীষ্টাব্দের। তখনও বিজয় গুপ্তের সময় নিয়ে কোন বিরোধ বা বিতর্ক দেখা দেয় নি বলে এই বিষয়ে এই সংস্করণের সাক্ষ্য মূল্যবান।
এই সংস্করণে এই রচনাকালনির্দেশক শ্লোকটি পাওয়া যায়—
ঋতু শূন্য বেদ শশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতিতিলক ৷
বিজয় গুপ্তের নিজের গ্রামের পুথিতেও শ্লোকটির এই পাঠই পাওয়া গিয়েছে। এর থেকে জানা যায়, ১৪০৬ শকে (=১৪৮৪-৮৫ খ্রীঃ) বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল রচিত হয়েছিল। কিন্তু ঐ সময়ে কোন সুলতান হোসেন সাহাকে পাওয়া গেল না। হোসেন সাহা বলতে সকলে আলাউদ্দীন হোসেন শাহকেই জানতেন। তিনি ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এর জন্য অনেকে রচনাকালজ্ঞাপক শ্লোকটির অকৃত্রিমতায় সন্দেহ প্রকাশ করলেন।
তখন কোন কোন গবেষক জানালেন একখানি পুথিতে 'ঋতু শূন্য বেদ শশী'র জায়গায় 'ঋতু শশী বেদ শশী' পাঠ পাওয়া গিয়েছে। ১৪১৬ শক ( =১৪৯৪-৯৫ খ্রীঃ) আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালের মধ্যে পড়ে বলে অনেকে এই পাঠ গ্রহণ করলেন। কিন্তু অনেকেরই সন্দেহ ঘুচল না। কারণ, যে পুথিতে এই পাঠ পাওয়া গিয়েছিল, তার কোন পাত্তাই পাওয়া যায় নি।
আমাদের মনে হয়, 'ঋতু শশী বেদ শশী' পাঠ আসলে কোন পুথিতে আদৌ ছিল না। ১৪০৬ শকে হোসেন শাহকে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ রচনাকালজ্ঞাপক শ্লোকটি কৃত্রিম প্রমাণিত হলে বিজয় গুপ্তের প্রাচীনত্বের দাবি কমে যায়। এইসব কারণেই ‘ঋতু শশী বেদ শশী' এই কাল্পনিক পাঠের উদ্ভাবন করা হয়েছিল। আসলে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলের প্রাচীনতম মুদ্রিত সংস্করণ এবং তাঁর নিজের গ্রামের পুথির সাক্ষ্যই ঠিক। ঋতু শূন্য বেদ শশী' পাঠই শুদ্ধ। ১৪৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ছিলেন বটে, কিন্তু আর এক হোসেন শাহ্ ছিলেন। তাঁর রাজকীয় নাম জলালুদ্দীন ফতেহ শাহ হলেও সাধারণের কাছে তিনি হোসেন শাহ্ নামেই পরিচিত ছিলেন। ইনি “পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বংশের লোক। এঁর রাজত্বকাল ১৪৮১-১৪৮৭ খ্রীঃ। এঁর সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকার সম্পাদিত History of Bengal (Vol. II) -এ লেখা আছে, "...named Husain, who on his accession assumed the title of Jalaludin Fath" "Most of his coins bear, after the regnal, titles, the words 'Husain Shahi', which, like the 'Badr Shahi' of Ghiyasuddin Mahmud of the Husaini dynasty, must refer to his popular name. (p.136)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৪০৬ শক বা ১৪৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দ বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলের প্রকৃত রচনাকাল এবং হোসেন সাহার উল্লেখের সঙ্গে এর কোন বিরোধ নেই।
এছাড়া আরও কতকগুলি বিষয় থেকে মনে হয় যে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল
জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়েছিল। সেগুলি এই :-
(ক) বিজয় গুপ্তের 'মনসামঙ্গলে'র হাসন-হোসেন পালায় হিন্দুদের প্রতি মুসলমানদের অত্যাচারের একটি চিত্র পাওয়া যায়। জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের রাজত্বকালে এই ধরনের অত্যাচার যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তা বৃন্দাবনদাসের 'চৈতন্যভাগবত' ও জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' থেকে জানা যায়। ('বাংলার ইতিহাসের দু'শো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল, ২য় সংস্করণ, পৃঃ ২২৪-২৩৫ দ্রষ্টব্য।)
(খ) বিজয় গুপ্তের বাসভূমি ফুল্লশ্রী গ্রাম “মুল্লুক ফতেয়াবাদ”-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে বিজয় গুপ্ত লিখেছেন। এই “ফতেয়াবাদ” বা ফতেহাবাদ জলালুদ্দীন ফতেহ শাহের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এখানকার টাকশাল থেকে তাঁর অনেকগুলি মুদ্রা উৎকীর্ণ হয়েছিল।
(গ) বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল যদি ১৪১৬ শকাব্দ বা ১৪৯৪-৯৫ খ্রীষ্টাব্দেই রচিত হয়ে থাকে, তা হলে বলতে হবে- আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের কয়েক মাসের মধ্যেই এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল; তা হলে, বিজয় গুপ্ত রাজা হিসাবে "হোসেন সাহা"র যে প্রশংসা করেছেনে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে, কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে নতুন রাজা এতখানি যোগ্যতার পরিচয় দেবেন এবং সুদূর ফতেহাবাদ অঞ্চলে সে কথা ছড়িয়ে পড়বে বলে ভাবা যায় না। কিন্তু বিজয় গুপ্ত ১৪০৬ শকাব্দ বা ১৪৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থ রচনা করে থাকলে এই প্রশ্ন ওঠে না, কারণ জলালুদ্দীন ফতেহ শাহ্ কয়েক বছর আগে থাকতেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর রাজ্যের সব অঞ্চলের লোকেরাই ইতিমধ্যে তাঁর যোগ্যতার পরিচয় পেয়েছিলেন। এ থেকেও বলা যায়, বিজয় গুপ্ত কর্তৃক উল্লিখিত “হোসেন সাহা" আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্ নন, জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহ্। সুতরাং বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল যে ১৪৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দেই রচিত হয়েছিল, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
'মনসামঙ্গল কাব্যের সূচনায় বিজয় গুপ্তই যে সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তার থেকে জানা যায় যে-বিজয় গুপ্তের নিবাস ছিল (বর্তমানে বাংলাদেশের বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত) ফুল্লশ্রী গ্রামে; গ্রামটি ছিল ফতেয়াবাদ বা ফতেহাবাদ “মুল্লুক”-এর বাঙ্গারোড়া তকসিমে অবস্থিত; এর পশ্চিম দিক দিয়ে ঘাঘর এবং পূর্ব দিক দিয়ে ঘণ্টেশ্বর নদ প্রবাহিত হত; গ্রামটিতে “চারি বেদধারী” ব্রাহ্মণরা, “নিজ শাস্ত্রেতে কুশল” বৈদ্যরা, লিখনিপুণ কায়স্থরা এবং অন্য কোন কোন জাতির লোকেরা বাস করত, এই গ্রামের সব লোকই “গুণময়” ছিল বলে কবি লিখেছেন; তাঁর পূর্ববর্তী কবি কাণা হরি দত্তের 'মনসামঙ্গল' মনসার পছন্দ না হওয়াতে ও তা লুপ্ত হওয়াতে মনসা বিজয় গুপ্তকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে নতুন 'মনসামঙ্গল' লিখতে আদেশ দেন।
তথ্যসূত্র
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম - সুখময় মুখোপাধ্যায়
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন