১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও বিদ্রোহের বিবরণ দাও। [জ্ঞানমূলক প্রশ্ন]

পূর্ব কথা: ভারতের প্রাচীনতম আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়। বিহারের ছোটোনাগপুরের বিস্তীর্ণ অরণ্যাঞ্চলে এদের বাস। এরা ছিল স্বাভাবিকভাবে সরল, অনাড়ম্বর কিন্তু পরিশ্রমী। অরণ্য পরিবেশে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত থেকে কিন্তু রেহাই পেল না। জমিদারদের অত্যাচার, শোষণ এবং মাত্রাতিরিক্ত কর ধার্যে তারা জমিহারা হল। বাধ্য হয়ে তারা মানভূম, ধলভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, মালদহ, ভাগলপুর অঞ্চলে নতুন বসতি স্থাপন করে। জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ করে দামিন-ই-কোহ্ (করমুক্ত পাহাড়ের প্রান্তদেশ)-তে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়ে তোলে।
কিন্তু কিছুকালের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল। অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে তা বিদ্রোহের রূপ নেয়।

■ সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ:

প্রথমত, ভূমিকর: কিছুকাল পরে ওড়িয়া, বিহারি ও বাঙালি জমিদাররা এই জমিতে চড়া হারে কর আরোপ করে। জমিদাররা মাঝে মাঝে খেয়ালখুশি মতো কর বৃদ্ধি করত। কর দিতে না পারলে তাদের জমি থেকে উৎখাত করত। জমিদারদের অত্যাচার ও নির্দয় ব্যবহার ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ।

দ্বিতীয়ত, মহাজনদের চড়া সুদ: জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাঁওতালরা মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদের হারে অর্থ সংগ্রহ করে জমিদারের দেনা (কর) মেটাত। সাঁওতালদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে মহাজন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বিরাট অঙ্কের ঋণ তাদের ওপর চাপিয়ে দিত। ঋণগ্রস্ত সাঁওতালরা ঘটি-বাটি সমস্ত জিনিস বিক্রয় করে মহাজনদের ঋণ মেটাত। ঋণের দায়ে তারা চাষের ফসল, জমির ফসল, এমনকি নিজেদেরও বন্ধক দিত। জমিদার ও মহাজনের যৌথ শোষণে সাঁওতাল কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। মহাজনের ঋণ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারত না।

তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার: সরকারি কর্মচারীরা সাঁওতালদের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিত। তারা তাদের বেগার খাটাত। অযথা নানারকম হয়রানি করত। সরকারের প্রতিভূ হিসাবে তারা সাঁওতালদের অযথা নানা নির্দেশ দিত। গরিব সাঁওতালরা তাদের নানারকম উপঢৌকন দিতে বাধ্য থাকত। সাঁওতালদের সবই সহ্য করতে হত। কিন্তু তাদের সহ্যেরও সীমা অতিক্রম করল।

চতুর্থত, ব্যবসায়ী-দোকানদারদের দ্বারা প্রতারণা: সাঁওতালরা অরণ্যের পরিবেশে মানুষ। তারা গরিব কিন্তু অসৎ নয়। পক্ষান্তরে সাঁওতালদের সরলতার সুযোগে ব্যবসায়ী দোকানদাররা অসৎ প্রবৃত্তি চরিতার্থ করত। ন্যায্যমূল্যের বদলে অধিক মূল্যে সাঁওতালদের কাছে দ্রব্যাদি বিক্রয় করত। তারা কেনারাম বাটখারায় সাঁওতালদের কাছ থেকে কম ওজনে দ্রব্যাদি ক্রয় করত। আবার বেচারাম বাটখারায় অধিক ওজনে দ্রব্যাদি বিক্রয় করত।

পঞ্চমত, দারোগার কদর্যতা: পুলিশ-দারোগা শান্তিরক্ষক। কিন্তু সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে থানার দারোগা ছিল সাক্ষাৎ জল্লাদ। সাঁওতালদের অভিযোগের প্রতিকার হত না। দারোগা ছিল জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষক। দারোগাও সাঁওতালদের যথারীতি হয়রানি করত। ষষ্ঠত, নারীর সম্মানহানি: এই অঞ্চলে ইউরোপীয় সেনাদল, অন্যান্য বহিরাগতরা সাঁওতাল রমণীর মর্যাদাহানি করত।

সপ্তমত, অধিকারবোধ লুপ্ত: সাঁওতাল কৃষকরা মনে করত যে, জমিতে যে শ্রমদান করে জমি তারই। ইংরেজ প্রশাসন তাদের জানাল যে সাঁওতালরা নেহাতই কৃষকমাত্র। জমিদারই জমির মালিক। তাদের চিরাচরিত প্রথাগত ধারণা মূল্যহীন। সাঁওতালরা এই বিশ্লেষণ মেনে নিতে পারেনি। সরকার জানায় বৃক্ষের ওপর তাদের অধিকারের ধারণা অমূলক। সরকারের এই নির্দেশে সাঁওতালরা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়। ডঃ বিপান চন্দ্র, বরুণ দে এবং অমলেশ ত্রিপাঠী Freedom Struggle পুস্তকে জানান যে, গাছের অধিকারকে কেন্দ্র করেই সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়।

অষ্টমত, মিশনারি কার্যকলাপ: খ্রিস্টান মিশনারিরা অর্থাভাবে ক্লিষ্ট সরল কৃষকদের একাংশকে ধর্মান্তরিত করে। সাঁওতালরা এরকমভাবে তাদের 'ধর্মে আঘাত' মেনে নিতে পারল না। তাদের সমাজের প্রথাগত ধর্মের অবমাননা সাঁওতালদের অতিশয় ক্রুদ্ধ করে।

নবমত, 'দিকু'দের প্রতি ঘৃণা: স্বাভাবিকভাবে সাঁওতালরা অতিথিপরায়ণ। কিন্তু 'দিকু'-দের (বহিরাগতদের) আচরণ তাদের কাছে নিন্দনীয় হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞতায় তারা উপলব্ধি করে যে জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী, ইংরেজ, বিহারি, বাঙালি, সব 'দিকু'ই সমান, দিকুদের জন্যই তাদের অরণ্যের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।

দশমত, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ: ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ অরণ্য অঞ্চলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেছিল। জমিদাররা ইংরেজদের তৈরি। তারা সাঁওতালদের জমি হরণ করে। জমিদারদের জন্যই সাঁওতালদের দুর্গতি। এছাড়া বহিরাগত ব্যবসায়ী, মহাজন, সরকারি কর্মচারী প্রমুখের শোষণ এবং অত্যাচারের জন্য সাঁওতালরা ইংরেজ সরকারকেই মূলত দায়ী করে।

একাদশত, অনাবৃষ্টির সুযোগে মহাজনদের শোষণ: ১৮৫৩ ও১৮৫৪ সালের অনাবৃষ্টি সাঁওতালদের দুর্গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে তারা বাধ্য হল। সুযোগ বুঝে মহাজনরা সুদের হারও বৃদ্ধি করে। মহাজনদের এই শোষণই ছিল মারাত্মক।

দ্বাদশত, জমিদার-মহাজনদের স্বার্থরক্ষা: প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ অন্ধভাবে জমিদার-মহাজনদের স্বার্থরক্ষা করে।

ত্রয়োদশত, ইংরেজ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার: এই সময়ে এই অঞ্চলে রেললাইন তৈরির কাজ শুরু হয়। বহু ইংরেজ কর্মচারী তখন একাজে নিযুক্ত হয়। তারা অতি সামান্য মূল্যে অথবা বলপূর্বক সাঁওতালদের ফসল, হাঁস-মুরগি, ছাগল ইত্যাদি ধরে নিয়ে যেত। এমনকি তারা সাঁওতাল রমণীদের সম্মানহানি করত। 

■ বিদ্রোহ:

সরল উপজাতিরা প্রথমে কিন্তু বিদ্রোহ শুরু করেনি। শোষণ আর বঞ্চনার শিকারে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বে তারা অপরাধীতে পরিণত হয়। অভাবের তাড়নায় জমিদার-মহাজনদের বাড়িতে ডাকাতি শুরু করে। শোষণ-পীড়ন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়লে সাঁওতালরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয় (১৮৫৫ খ্রিঃ)। সিধু মাঝি ও কানহু মাঝির নেতৃত্বে প্রায় দশহাজার সাঁওতাল সিধু ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয়ে হুল (বিদ্রোহ) ঘোষণা করল (জুলাই, ১৮৫৫ খ্রিঃ)। রাজমহল থেকে মুরশিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রসারলাভ করে। প্রায় দু'লক্ষ সাঁওতাল বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। কামার, ছুতোর, তাঁতি, ডোম শ্রেণির নিম্নবর্ণের মানুষ বিদ্রোহকে সমর্থন করে। সিধু-কান্তুর অপর দুই ভাই চাঁদ-ভৈরবও নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন। বিদ্রোহীরা কোম্পানির শাসনের অবসান ও নিজেদের সরকার (সভা) প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করল। তারা সংখ্যায় ১০ হাজার করে বিভিন্ন দলে জড়ো হয়ে ভাগলপুর ও রাজমহলের মধ্যে ডাকবিভাগ ও রেল চলাচলের যোগাযোগ ছিন্ন করে এবং নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। ("They assembled in different parts in the parties of 10,000 each, cut off the postal and railway communications between Bhagalpur and Rajmahal and were in complete control of this area"-R. C. Majumder, History of the Freedom Movement in India, Vol. 1, P-126.)

বিদ্রোহীরা মহাজন, জমিদার, আমলা, পুলিশ, উচ্চবর্ণের এদেশীয় সকলকেই আক্রমণ করে। ইংরেজও তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। তারা ইংরেজদের বাংলো আক্রমণ করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করে। তারা ইংরেজ কর্মচারী এবং নীলকরদের হত্যা করে।

"Armed chiefly with axes and poisoned arrows, large bodies of these half- reclaimed savages carried fire and sword into scores of happy villages, attacked every outflying European Bungalow, murdered with equal readiness English planters and railway servants, native police officers, tradesmen, their wives and children, and even swarmed up to the larger European stations in the districts of Birbhum, Rajmahal and Bhagalpur." (R. C. Majumder, History of the Freedom Movement in India, Vol. 1. P-126)

বিদ্রোহীরা অত্যাচারী মহেশ দারোগা এবং কুখ্যাত মহাজন কেনারাম ভগতকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। কয়েক মাসের জন্য সাঁওতাল অধ্যুষিত এই বিস্তৃত অঞ্চল মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হতবাক হয়ে পড়ে। ভয়ার্ত দেশীয়রা দলে দলে ওই অঞ্চল ত্যাগ করে।

বিদ্রোহ দমন:

বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজ সেনাবাহিনী প্রেরিত হয়। কিন্তু তাদেরও বিদ্রোহীরা ব্যতিব্যস্ত করে। সৈন্যাধ্যক্ষ মেজর বারবো ফিরে যান। অবশেষে নারকীয় অত্যাচার চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করা হয় (ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ খ্রিঃ)। ২৩ হাজার বিদ্রোহী নিহত হয়। চাঁদ-ভৈরব যুদ্ধে প্রাণ দেন। বন্দি সিধুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কান্ডুকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

■ ফলাফল:

বিদ্রোহ ব্যর্থ হল। সাঁওতালদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হল না। কিন্তু বিদ্রোহের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্রোহ দমন করার পরে ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের সমস্যা সমাধানে দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য হয়।

প্রথমত, সাঁওতাল জেলা: সরকার জমিদার-মহাজনদের শোষণ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। সাঁওতালদের জন্যই সাঁওতাল পরগনা নামে একটি জেলা গঠন করে। এখানে জমিদার-মহাজন সহ অন্যান্য বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত করা হয়।

দ্বিতীয়ত, অনুমোদিত সুদের হার: মহাজনদের সুদের হার নির্দিষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। তৃতীয়ত, নতুন আদালত: ব্রিটিশ আইনের সহজ সাহায্য পাওয়ার জন্য নতুন আদালত গঠন করা হয়। এছাড়া সাঁওতালদের নিজেদের প্রথায়ও বিচারকার্য সম্পন্ন করার অধিকার দেওয়া হয়।

চতুর্থত, কারচুপি অব্যাহত: এতদসত্ত্বেও বলা যায় যে, সাঁওতালরা কিন্তু জমির ভোগদখলের অধিকার ফিরে পায়নি। জমিদার-মহাজনদের শোষণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত নিয়মে চলতে থাকে। আবার সাঁওতালদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে ১৮-৭০-৮২ খ্রিস্টাব্দে খেরোয়ার হুলে (বিদ্রোহে) ফেটে পড়ে।

■ মন্তব্য: আদিবাসীদের বিদ্রোহ হলেও সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারতের কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জমিদার-মহাজনের এবং শাসক শ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সাঁওতালদের এই মরণপণ সংগ্রাম বিশেষ গুরুত্ববহ। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশশাসন বিরোধী এবং যথার্থই ছিল মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সাঁওতালদের এই সংগ্রামকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের মর্যাদা দেওয়া উচিত।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ