ফরাজি আন্দোলনের বিবরণ দাও। [জ্ঞানমূলক প্রশ্ন]

ভারতে ইংরেজদের শাসনব্যবস্থায় বহু সম্ভ্রান্ত মুসলিম রাজকর্মচারী কর্মচ্যুত হয়। নতুন ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থায় অনেক মুসলিম জমিদার জমিদারি হারায়। নবাবের ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ায় বহু কর্মচারী বেকার হয়। বিলাতি বস্ত্রের আমদানির ফলে অনেক তাঁতির রুজি-রোজগার বন্ধ হয়। এছাড়া নতুন জমিদারদের শোষণ, নীলকরদের অত্যাচার, নায়েব-গোমস্তাদের দরিদ্র কৃষকদের ওপর অত্যাচার-সবকিছু মিলিয়ে মুসলিম কৃষকদের কট্টর ইংরেজ বিরোধী করে তোলে। সঙ্গে যুক্ত হল ধর্মরক্ষার বাতাবরণ। এরই বহিঃপ্রকাশ ফরাজি ও ওয়াহাবি আন্দোলন। উনিশ শতকে বাংলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও আন্দোলন দুটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

■ বৈশিষ্ট্য

(১) আন্দোলন দুটির নেতৃত্বে ছিল মুসলিম নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠী। 

(২) উভয় আন্দোলনই বহিরাগত বৃহত্তর ধর্মীয় আন্দোলন থেকে প্রেরণা লাভ করে।

(৩) আন্দোলন মূলত কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ফরাজি আন্দোলন:

ফরাজি কথার অর্থ 'ইসলাম নির্দেশিত কর্তব্য'।

নেতৃত্ব ও আন্দোলন: বাংলার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইসলামের পবিত্রতা রক্ষার সঙ্গে কৃষক সমাজের শোষণমুক্তি ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য বিষয়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, দেশ থেকে ব্রিটিশ বিতাড়ন এবং মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল।*

শরিয়ত উল্লাহ: ফরাজি আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। এই আন্দোলন বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ফরাজি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন হাজি শরিয়ত উল্লাহ্। তিনি মক্কায় দীর্ঘকাল অবস্থানকালে সেখানেই ইসলামের শুদ্ধি আন্দোলন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। হাজি দেশে ফিরে ধর্মসংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। দানশীলতা ও ধর্মানুরাগের জন্য তিনি ইতিমধ্যেই সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। 

হাজি ইংরেজ অধিকৃত ভারতকে শত্রুর দেশ (দার-উল-হারব) বলে ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর অনুসরণকারীদের নিয়ে তথাকথিত ঈশ্বর নির্দেশিত পথে (ফরাজি) ইসলামের শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের আঘাত করে। আন্দোলন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল জমিদার, মহাজন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে। স্বভাবতই প্রতিপক্ষ তীব্র প্রত্যাঘাত করে। আন্দোলন চলে ১৮২০ খ্রিঃ থেকে ১৯০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত। হাজি বেশ কিছুদিন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে জমিদারের প্রতিপক্ষ হিসাবে ফরাজি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

মহম্মদ মহসিন: হাজির মৃত্যুর (১৮৩৭ খ্রিঃ) পরে তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসিন (দুদুমিয়া) ফরাজি আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল আরও বেশি। তিনি ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর থেকে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি হলকোয়াস (বিভাগ)-এ পরিণত করা হয়। হলকোয়াসগুলি পরিচালনা করতেন খলিফারা (সহকারী)। নেতা ও অনুগামীরা ওস্তাদ ও কারিগর নামে অভিহিত হত।

**There was a feeling that real object of the Faraze Movement was the expulsion of the British and restoration of Muslim rule"-Vide History of the Freedom Movement in India, Vol 1, p. 118.

দুদুমিয়াঁর নেতৃত্বে ফরাজি প্রভাব ফরিদপুর-ঢাকা থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফরাজি সদস্য দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। নিম্নবর্গীয় হিন্দুরাও ফরাজি আন্দোলন সমর্থন করে।

দুদুমিয়াঁ ঘোষণা করেন যে, জমির মালিক আল্লাহ। কাজেই জমিদার বা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। জমিদার ও নীলকরদের অভিযোগে অবশেষে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি অবশ্য মুক্তি লাভ করেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বাহাদুরপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।

আবদুল গফুর: ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন দুদুমিয়াঁর পুত্র আবদুল গফুর বা নোয়া মিয়া। আন্দোলন কিন্তু ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে যায়। অবশেষে ফরাজি আন্দোলন নিছকই ধর্মীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।

• মন্তব্য: এই আন্দোলনের বড়ো অবদান ছিল দরিদ্র মুসলিম ও হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হয়ে জমিদার ও ইংরেজদের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ