প্রার্থনা কবিতার মূল বিষয় ও সনেট হিসেবে কবিতাটির সার্থকতা বিচার
কবিতার একটি বিশেষ আঙ্গিক হল সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। বাংলা কবিতায় মধুসূদনের কাব্যে সনেটের সূচনা হলেও এই ধারাটি সার্থক ভাবে পরবর্তী ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়নি। তবু কিছু কিছু আধুনিক কবি, যেমন - প্রমথ চৌধুরী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ সেন প্রমূখ কবিগণ সনেট রচনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দের মতো রোমান্টিক কবিদের কলমের মধ্যেও সনেটের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এদিক থেকে অজিত দত্ত এই ধারার গতিটিতে সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। সনেট রচনায় কবির আগ্রহের কথা কবি নিজের মুখেই বলেছেন তাঁর 'কবিতা সংগ্রহ'- এর ভূমিকায়। সেখানে তিনি বলেছেন -
"অতি অল্প বয়স থেকেই আমি সনেট রচনা করেছি, যখন আমার সতীর্থ ও বন্ধুগণের কেউই এই বিশেষ ফর্মটির দিকে আকৃষ্ট হয়নি।"
সনেটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর সুসংহত প্রকাশ। চৌদ্দ পঙক্তির সীমিত আকারে এর আবেগ ও ভাবকে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। সনেটের সংজ্ঞায় বেইন বলেছেন-
"The sonnet is a short lyrical poem complete in one stanza containing fourteen lines or five measured verse."
অবশ্য চৌদ্দ পঙক্তি বা পাঁচটি স্তবকের কথা বলা হলেও ভাব সর্বক্ষেত্রে এই আকারে সীমাবদ্ধ থাকে না। তবে এর স্তবক বিন্যাস ও মিল বিন্যাসের মাধ্যমে তা যে অনেকটাই সুনিয়ন্ত্রিত, সে কথা স্বীকার করতেই হয়।
এই বিশিষ্ট রূপরীতিতে অজিত দত্তের সনেট কতখানি সাফল্য অর্জন করেছিল, সেটাই আমাদের বিচার্য বিষয়। বুদ্ধদেব বসু একবার অজিত দত্তের 'কুসুমের মাস' কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বলেছিলেন-
"প্রথমেই বলে রাখি টেকনিকের দিক থেকে অজিত কুমারের সনেটগুলি অনবদ্য, বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ।"
অজিত দত্তের প্রার্থনা কবিতার বিষয়বস্তু অনুযায়ী এটি একটি আত্মকথনমূলক সনেট। এই সনেটটিতে পেত্রাকের সনেটের আদল অনুসারে চৌদ্দটি চরণ আছে। অষ্টক ও ষটক নামে আলাদা স্তবক থাকলেও ভাবের সমন্বয় এখানে পরিলক্ষিত হয়। এখানে অষ্টক রচনার ক্ষেত্রে কবি দুটি চতুস্ক গ্রহণ করেছেন। যার মিল গুলি হল এরকম - ক খ খ ক, ক খ খ ক। আর ষটকের ক্ষেত্রে মিল বিন্যাস হল এরকম - গ ঘ, ঘ গ, গ ঘ। এই স্তবকের প্রথম চার পঙক্তির পরে কবি পূর্ণচ্ছেদ দিয়েছেন। তারপর শেষ দুটি পঙক্তিতে তাঁর আক্ষেপ ও প্রার্থনা সহজেই অবারিত হয়েছে।
প্রার্থনা কবিতার প্রথম অষ্টকে আমরা দেখতে পাই যে কবি এই গতানুগতিক জীবনের অন্তঃসার শূন্যতায় ক্লান্ত হয়েছেন। এই জীবনের বদ্ধ কারাগার থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে সেই মুক্তির আবেদন রাখা হয়েছে। কবিজীবনের মূল সমস্যাটি এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। আর দ্বিতীয় স্তবক বা ষটকে কবি সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের পথের সন্ধান করেছেন। তাই কবি বর্তমানের আলস্য থেকে , জড়ত্ব থেকে কৈশোরের সেই জীবন ফিরে পেতে চেয়েছেন। আপাত সুখ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত এই জীবন যতই পরিহাস ও আনন্দময় মনে হোক না কেন, এই বন্ধ্যা জীবন আসলে কবির মতে নিয়তির পরিহাসের মতোই ব্যর্থতাসূচক। এইজন্য এই সময় কবির কাছে পুষ্প কারাগার বলে মনে হয়েছে। কবির বক্তব্য পূর্ণরূপে সমাপ্তিলাভ করেছে সনেটের শেষ স্তবকে। এইভাবে ভাবের সংহতি দানে সনেটটি হতে উঠেছে অনবদ্য ও সার্থক।
পরিশেষে একটা কথা বলতেই হয় যে, কবিমনের আক্ষেপ ও আবেগকে কবি এখানে সুনিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই কারণে সনেটের প্রগাঢ় বন্ধন এখানে যে পুরোপুরি অনুসৃত হয়েছে, সেই সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।