বায়ু দূষণ কাকে বলে? বায়ু দূষণের কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

■ বায়ু দূষণের সংজ্ঞা : 

পার্থিব সমস্ত জীবের জীবনধারণের জন্য বায়ু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুতে কতকগুলি গ্যাসীয় উপাদান, জলীয় উপাদান ও ধূলিকণা নির্দিষ্ট অনুপাতে থাকে, যাতে জীবকূলের কোনো ক্ষতিসাধন হয় না। কিন্তু বহুদিন ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট কারণে বায়ুমণ্ডলীয় উপাদানগুলির কয়েকটির উপস্থিতির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুর অরসাম্য নষ্ট হয়েছে এবং মানুষ তথা জীবকূলের ক্ষতি হচ্ছে। এই ঘটনাকেই বলা হয়। বায়ুদূষণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) বায়ু দূষণের সংজ্ঞায় বলেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থযুক্ত হওয়ায় যখন সেটি মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে তখন সেই অবস্থাকেই বলা হয় বায়ু দূষণ।

• বায়ু দূষণের কারণ : 


বায়ু দূষণ বর্তমানে সমগ্র বিশ্বেই বড়ো সমস্যা। সভ্যতার যত অগ্রগতি হচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাও দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বায়ু দূষণের পিছনে রয়েছে কতকগুলি প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক কারণ।

• প্রাকৃতিক কারণ : 

বায়ু দূষণের উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক উৎসগুলি হল- 

(i) সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে নিঃসৃত বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান যেমন— কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড প্রভৃতি ও ছাই ভস্ম।

(ii) দাবানলের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান

(iii) ধূলিঝড় থেকে উত্থিত ধূলিকণা।

(iv) বিভিন্ন জৈব ও অজৈব পদার্থের পচনজনিত কারণে সৃষ্ট গ্যাস। 

• অপ্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট কারণ :

(i) দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বায়ু দূষণের বড়ো কারণ।

(ii) ব্যাপকহারে বনভূমি ধ্বংস করায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি ও অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া অর্থাৎ ভারসাম্য নষ্ট।

(iii) রাসায়নিক সার ও অ্যাসিড উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে নির্গত নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, বিভিন্ন আকৃতির ধূলিকণা বায়ুতে মিশছে।

(iv) সিমেন্ট কারখানা থেকে সিমেন্টের গুঁড়ো, লৌহ ইস্পাত কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ধাতব অক্সাইড বায়ু দূষণ ঘটায়।

(v) মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস বায়ুতে মেশে। এমনকি ঊর্ধ্বাকাশে বিমান থেকে নিঃসৃত সালফার ডাইঅক্সাইড বায়ুকে দূষিত করছে।

(vi) খনি অঞ্চল থেকে দূষিত ধূলিকণা বায়ুতে মিশছে।

(vii) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সূক্ষ্ম কয়লার কণা, ছাই প্রভৃতি বায়ু দূষকগুলি প্রতিনিয়ত বায়ুতে যুক্ত হচ্ছে।

(viii) পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বায়ুর সঙ্গে যুক্ত হয়।

(ix) দৈনন্দিন জীবনে জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের গ্যাস, ধোঁয়া, ছাই বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হয়।

(x) রেফ্রিজারেটর থেকে নির্গত ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, ক্লোরিন প্রভৃতি গ্যাসগুলি বায়ু দূষণ ঘটাতে সাহায্য করে।


• বায়ু দূষণের প্রভাব : 


বায়ু দূষণের প্রভাব একদিকে যেমন বায়ুমন্ডলের ওপর প্রভাব ফেলেছে, অপরদিকে উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী থেকে মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। যথা—

(i) দূষণের ফলে বায়ুতে গ্রিনহাউস গ্যাস যেমন : CO,, CFC, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলস্বরূপ বৃষ্টিপাত ও মৃত্তিকার জলের পরিমাণ হ্রাস এবং মেরু অঞ্চলের বরফের গলন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

(ii) বায়ু দূষণের ফলে উদ্ভিদের ক্লোরোসিস্ রোগের সৃষ্টি হয়। ফলে উদ্ভিদের পত্র ছোটো, বিবর্ণ হয়ে যায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যহত হয় ও অকাল বার্ধক্য ঘটে। 

(iii) বায়ু দূষণকারী বিভিন্ন গ্যাস যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার অক্সাইড প্রভৃতির প্রভাবে প্রাণীর বৃদ্ধি, বিকাশ ও বংশবিস্তারে ব্যাঘাত ঘটছে।

(iv) দূষিত বায়ু শ্বাসপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করায় মানুষের নানা ধরনের অসুখের সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন- ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, মস্তিষ্ক সংক্রান্ত অসুখ প্রভৃতি।

(v) বায়ু দূষণের প্রভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস ও তাদের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

(vi) বায়ু দূষণের ফলেই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়।

• বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ : 


বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। যথা- 

(i) জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের পরিমাণ কমাতে হবে। 

(ii) পরিবর্ত জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। 

(iii) শিল্প কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণের মাত্রা কমাতে হবে। 

(iv) বনভূমিতে যাতে দাবানল না লাগে তার জন্য শুকনো ডালপালা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা। 

(v) বায়ু দূষক কণাগুলিকে আটকানোর জন্য শিল্পকেন্দ্রের চিমনিতে ফিলটারের ব্যবহার করা। 

(vii) বায়ু দূষণের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলা প্রভৃতি।

• গ্রিনহাউস প্রভাব ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং : 


বায়ু দূষণ জনিত কারণে বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির বৃদ্ধির ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির ঘটনাকেই বলা হয় গ্রিনহাউস প্রভাব। সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি হওয়াকেই বিজ্ঞানীগণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামকরণ করেছেন। ১৮৫০-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত উন্নতা বৃদ্ধির গড় ০.৫° সে. এবং ১৯০০-২০০০ খ্রিস্টাব্দে ১° সে.। বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর উয়তা বৃদ্ধির পরিমাণ হবে প্রায় ৩.৫° সে.। পৃথিবী ব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল কারণগুলি হল- প্রথমত, জীবাশ্ম জ্বালানীর দহন, দ্বিতীয়ত, পচা জৈব আবর্জনা থেকে সৃষ্ট মিথেন গ্যাস, তৃতীয়ত, ইলেকট্রনিক্স শিল্প ও রেফ্রিজারেশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বৃদ্ধি প্রভৃতি। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মেরুপ্রদেশে ও উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করায় সমুদ্র জলতলের উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিস্তীর্ণ ভূমিভাগ সমুদ্র জলে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে বাস্তুতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান।

• ওজন হোল (Ozone Hole) : বায়ু দূষণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তর দ্রুত ক্ষয় পাচ্ছে এবং এই স্তরে অসংখ্য ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। একেই বলা হয় ওজোন হোল। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটি আবিষ্কৃত হয়। এর প্রভাবে সূর্যের ক্ষতিকারক অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে।

• মনে রাখা দরকার •


জীবকূলের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সমষ্টিই হল পরিবেশ।

মানুষের চাহিদা ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিবেশকে দূষিত করছে।

জৈব পদার্থের পচন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ থেকে সৃষ্টি গ্যাস প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশ দূষণ করে।

পরিবেশ দূষণের মনুষ্যসৃষ্ট কারণ—জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি, বনভূমি ধ্বংস, কলকারখানা ও প্রাত্যহিক জীবনে স্বাচ্ছন্দসৃষ্টির জন্য উদ্ভাবন করা বিভিন্ন উপাদান। 

অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, অম্লবৃষ্টি, বিভিন্ন বর্জ্যপদার্থ ভূমিদূষণ করছে। ভূমি দূষণের ফলে ভবিষ্যতে কৃষিকাজ ব্যহত হবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ